জঙ্গলবাড়ির ভূত



এক ছিল বাগানবাড়ি। এই বাগানবাড়িতেই কোনো এককালে এক জমিদারের আলিশান বাড়ি ছিল। বাড়ি তো নয় যেন এক চোরাকুঠুরি। নতুন কেউ সেই বাড়িতে একবার ঢুকলে দ্বিতীয়বার ঢুকতে চাইতো না। বিশাল সেই বাড়িতে এতো সব ঘর আর অলিগলি পথ ছিল যে জমিদারের লোকদের সাহায্য ছাড়া বাইরে বের হওয়া ভারী কঠিন ছিল। বিশাল বাগানবাড়ির এখানে ওখানে ছিল বেশ কয়েকটা পুকুর। নানান ঘটনার সাক্ষী সেই বাগানবাড়িটা এখন আর আগের মতো নেই। থাকবে কী করে, জমিদার বাবু মরে যাওয়ার পর তার ছেলেমেয়েরা কেউ আর ও-বাড়িতে থাকতো না। যে যেদিকে পেরেছে চলে গিয়েছিল। এ-কাজ সে-কাজ নিয়ে এক সময় জমিদার বাড়িতে যাদের আসা-যাওয়া ছিল তারাও আর কেউ এ-মুখো হতো না। একটা সুন্দর তকতকে ঝকঝকে বাড়িতে বহু বছর কেউ না থাকলে বা তার যতœ-আত্তি না নিলে যা হয় আরকি।
জায়গায় জায়গায় শ্যাওলাধরা ইট খসে যাওয়া দেয়াল আর উঁচু ঢিবি ছাড়া ওই বাগানবাড়িতে এখন আর কিছু নেই। আশপাশের মানুষের কাছে এককালের বাগানবাড়িটা তাই এখন জঙ্গলবাড়ি হিসেবে পরিচিত। দিনে দিনে এখানে যে কতো গাছপালা জন্ম নিয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িটা এখন ভয়ঙ্কর সব সাপ, নানান রকম পাখি আর বন্যপ্রাণীদের আবাস হয়েছে। ওই বাড়িতে এই আছে সেই আছে বলে, মানুষের মুখে নানান রকম কাহিনীও শোনা যায়।
জমিদারের বাগানবাড়ি মানে এখন যেটা জঙ্গলবাড়ি আরকি, সেই জঙ্গলবাড়ির পাশেই ছিল একটা ছোট্ট গ্রাম। নাম অভয়ডাঙা। অভয়ডাঙা থেকে মাইল কয়েক দূরেই ছিল একটা পাহাড়। শোনা যায়, বুনো হাতি আর অজগর সাপের ভয়ে ওই পাহাড়ের ধারে কাছেও কেউ যেত না। একবার নাকি ওই পাহাড় থেকে অভয়ডাঙা গ্রামে একটা হাতি ঢুকেছিল। পাগলা মেয়ে হাতি। পাগলা হাতি বন ছেড়ে হঠাৎ গ্রামে ঢুকে পড়লে যা করে আর কি। গ্রামে ঢুকেই মানুষের বাড়িঘর ভাঙা শুরু করলো সে। সামনে যাকে পায় তাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে গাছের সাথে এক বাড়ি মেরে পরপারে পাঠিয়ে দেয়। কখনো কখনো পায়ের তলায় ফেলে বেলুন ফোটানোর মতো ফটাস করে ফুটিয়ে দেয়। পাগলা হাতির এমন কায়কারবার দেখে গ্রামের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করলো।
অভয়ডাঙা গ্রামে গোঁয়ার টাইপের এক লোক বাস করতো। নাম ছিল মনা। গ্রামের কাউকে জমা দিয়ে চলতো না সে। নিজে যখন যা মনে করতো তাই করে যেত। তার এমন কাণ্ড দেখে গ্রামের লোকেরা তাকে মনা পাগলা নামে ডাকতো। তো, হাতির ভয়ে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পালিয়ে গেলেও মনা পাগলা কিন্তু পালালো না। পাগলা হাতিটাকে এক হাত দেখে নেবে বলে একদিন নিজের বাড়ির সামনের উঠোনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকলো সে। একটু পরেই চারপাশে শোরগোল উঠলো। কে কোথায় আছো, পালাও… গ্রামে পাগলা হাতি ঢুকেছে। শোরগোল শুনে আশপাশে তাকালো মনা পাগলা। দেখলো পাগলা হাতিটা ওর বাড়ির দিকেই আসছে। দেখতে দেখতে হাতিটা বাড়ির খোলাটে এসে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে সবাই হায় হায় করতে লাগলো। পাগলাটা সত্যিই সরলো না ওখান থেকে, আজ তো ওকে পায়ের তলায় ফেলে একেবারে পিষেই মারবে!


মনা পাগলা হাতির ভয়ে দৌড় দেয়া তো দূরের কথা এক চুল নড়লোও না জায়গা থেকে! হাতিটা কাছাকাছি আসতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। লুঙ্গিটা ভালো করে মালকোছা মেরে শক্ত করে মুঠ পাকিয়ে দাঁড়ালো। চোখের পলকে এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মহিষ যেমন গোঁয়ারের মতো হঠাৎ রুখে দাঁড়ায়। মনাও তাই করলো। পাগলা হাতিটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শুঁড় ধরে চরকার মতো মাথার চারপাশে ঘুরাতে লাগলো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হাতির তো কম্ম সারা। আজ এ কার পাল্লায় পড়লামরে বাবা। সবাইকে আমিই শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আচ্ছামতো ঘুরিয়ে… আর আজ আমাকেই কিনা একটা দু পেয়ে…
মাথার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হাতিটার প্রায় বমি এসে গেল। মনে হলো, সকালের দিকে খাওয়া কলাগাছ আর বেলগুলো পেট থেকে এখনই গরগর করে বেরিয়ে আসবে। হাতির পেটের খবরটা মনা পাগলা বুঝতে পেরেই হঠাৎ ঘুরানো বন্ধ করে শুঁড়টা ছেড়ে দিতেই অনেক দূরের এক গাছে গিয়ে বাড়ি খেয়ে মাটিতে সেই যে পড়লো আর উঠলো না।
মনা পাগলার হাতে হাতি মারার এই খবরটা এ-কান ও-কান হয়ে আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। মরা হাতিটাকে এক নজর দেখার জন্য আশপাশের গ্রামের লোকজন বানের পানির মতো অভয়ডাঙায় ছুটে আসতে লাগলো। লোকজনের সেই ভিড় থেকে কে যেন একজন বললো, অভয়ডাঙার মনা পাগলার সাহস আছে বটে। বেটা শুঁড় ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে একটা হাতি মেরে ফেললো! কে বলে এটা অভয়ডাঙা গ্রাম। এটা তো দেখছি হাতিমারা গ্রাম! ব্যস, সেই থেকে গ্রামটাকে আর কেউ অভয়ডাঙা নামে ডাকে না। আশপাশের গ্রামের সবার মুখে অভয়ডাঙা গ্রামের নাম এখন হাতিমারা!
তো এই হাতিমারা গ্রামের লোকজনও কোনোদিন জঙ্গলবাড়িতে পা রাখার সাহস করেনি। কারণ, ওই জঙ্গলে ঢুকলে নাকি কেউ বের হয়ে আসতে পারে না! কথাটা সত্য নাকি স্রেফ গালগপ্প সেটা জানার জন্য নানান বয়সের অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি। সবার সাথে কথা বলে যেটা জানা গেল সেটা হলো এর আগে রান্নার কাঠ কিংবা গাছের ফলমূল সংগ্রহের জন্য অনেকেই জঙ্গলবাড়িতে ঢুকেছিল। এ পর্যন্ত যারা ওই জঙ্গলে ঢুকেছে তাদের কেউ নাকি বাড়ি ফিরে আসেনি!
সাত পুরুষ ধরে সবাই লোকমুখে শুনে আসছে, বহু বছর আগে মনা পাগলা নামে একটা লোক যে পাগলা হাতিটাকে মেরে ফেলেছিল, সেই পাগলা হাতিটা এক সময় ভূত হয়ে গিয়েছিল। ভূত হওয়ার পর থেকে সে ওই জঙ্গলবাড়িতেই আছে। সুযোগ পেলেই সে নাকি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়। কাঠ বা ফলমূল সংগ্রহের জন্য যারাই জঙ্গলবাড়িতে ঢোকে তাদেরকেই ঘাড় মটকে রক্ত খায়। রক্ত খাওয়ার পর দু পেয়েদের হাড়গোড় আর মাথার চুল পাশেই ফেলে রাখে হাতিভূতটা!
হাতিমারা গ্রামের অনেকের ধারণা, হাতিভূতের একটা পুত আছে। তার নামটাও জেনে ফেলেছে তারা! হাতিভূতের পুতের নাম হলো মটকা। মায়ের সাথে মটকাও এই জঙ্গলে থাকে। বাগে পেলে সেও বাবার সাথে দু পেয়ে জন্তুদের ঘাড় মটকে রক্ত খায়! একদিন দু পেয়ে কারো ঘাড় মটকাতে না পারলে নাকি মটকার মাথা গরম হয়ে যায়। তখন সে নিজেই নিজের হাত-পা চিবিয়ে খাওয়া শুরু করে। আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে থাকে।
কিন্তু হাতিভূত আর তার ছেলে মটকা মোটেও ওরকম কিছু করে না। জঙ্গলবাড়িতে ঢুকে কেউ যাতে ওদের দেখতে না পায় সে জন্য ওরা গাছের ডালে ঝুলে না থেকে বড় কোনো গাছের নিচে সুড়ঙ্গ করে থাকে। সুড়ঙ্গটা দেখতে ঠিক মানুষের বাড়ির মতো। বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো রুম আছে বাড়িটায়। এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়ার জন্য অনেক দরোজাও আছে। প্রত্যেকটা রুমের ছাদে কিসের যেন কঙ্কাল ঝুলানো। মটকা সারাদিন এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়ে বেড়ায় আর কঙ্কালগুলো নিয়ে খেলা করে।
সব ভূত শিকার ধরার জন্য রাতবিরাতে বের হলেও হাতিভূত সেটা করে না। ওই সময় সে মটকাকে বুকের মধ্যে নিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায়। সকাল হলেই বাইরে বেরিয়ে যায়। জঙ্গলের এখানে ওখানে ঘুরে দু-একটা দু পেয়ে জন্তু ধরে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। মটকা নিজের ঘরে বসে সেই জন্তুগুলোর ঘাড় মটকে রক্ত খেতে খেতে মায়ের কাছে জানতে চায়, এই জন্তুগুলোর নাম কী মা? এদের রক্ত কিন্তু দারুণ টেস্টি!
মায়ের কাছে একটা আবদার করলো মটকা। বলল, মা, তুমি যে সব দু পেয়ে জন্তুগুলো ধরে আনো সেগুলোর অনেক বয়স। ওদের ঘাড় মটকে খুব একটা রক্ত পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওদের গায়ের হাড়গুলোও কেমন পাথরের মতো শক্ত। চিবাতে গেলে আমার মাড়ির দাঁতগুলো মরমর করে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি আমার দাঁতগুলো ভেঙে গেল। এই সব বুড়ো দু পেয়ে জন্তুগুলোর রক্ত খেতে আর ভাল্লাগে না মা। মাঝে মধ্যে দু-একটা দু পেয়ে জন্তুর ছানাপোনা নিয়ে এসো না। ভালো হয় যদি হাড়ে হাড়ে দুষ্টু আর যেগুলো মোটেই পড়ালেখা করতে চায় না এমন ছানাপোনাদের ধরে আনতে পারো। ওদের শুধু ঘাড় মটকে রক্ত খেতেই মজা না, ওদের নরম হাড্ডিগুলোও চিবিয়ে খাওয়া যায়!
কিছুক্ষণ আগেই মটকা একজনের ঘাড় মটকে রক্ত খেয়েছে। ওর চিবুক বেয়ে এখনো তাজা রক্ত ঝরছে! হাতিভূতটা মটকার চিবুক থেকে রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল, ঠিক আছে সোনা, এরপর তোকে দু পেয়ে জন্তুদের একটা দুষ্টু টাইপের ছানাপোনাই এনে দেবো। নে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে তো। আমার আবার সকাল সকাল বের হতে হবে।
মায়ের কথা শুনে মটকা বলল, তুমি কি ওটা কাল সকালেই এনে দেবে মা? মটকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বলল, হ্যাঁ, কাল সকালেই এনে দেবো। তবে একটা কথা, আমি সকালে বাইরে বের হলে কিন্তু তুই ভুলেও ঘর থেকে বের হবি না। এ-ঘর ও-ঘর ঘোরাঘুরি না করে চুপচাপ শুয়ে থাকবি। কোথাও কোনো শব্দ হলে গলা বাড়িয়ে দেখতে যাস না যেন। তুই কিন্তু এখনো অনেক ছোট। একবার হারিয়ে গেলে ঘর খুঁজে পাবি না। দু পেয়ে জন্তুগুলোর মধ্যে এক ধরনের জটাধারী বুড়ো লোক আছে। ওরা খুব হাড় বজ্জাত টাইপের হয়। ওদের কারো খপ্পরে পড়লে বিপদও হতে পারে!
মায়ের সামনে মটকা ভীষণ বাধ্য ছেলে। মা যা বলে তাতেই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যায়। কিন্তু মা ঘর থেকে বাইরে বেরোলেই মটকার আসল চেহারা দেখা যায়। ফড়িং ধরা দু পেয়ে দুষ্টু বালকদের মতো এ-ঘর ও-ঘর দৌড়ায় আর কঙ্কাল নিয়ে খেলা করে। খেলতে খেলতে ভালো না লাগলে দরোজার মুখে এসে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। জঙ্গলের কোথায় কে কী করছে চুপচাপ দেখতে থাকে।
এভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে খুব বেশি সময় ভালো লাগে না মটকার। শরীরের মধ্যে কেমন উসখুস করে তার। উপুড় হওয়া থেকে উঠে বসে। ভাবে, একটু যদি জঙ্গলটা ঘুরেটুরে দেখা যেত। গাবদাগোবদা শরীরটা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসে মটকা। মায়ের নিষেধ না মেনে এই প্রথম ঘরের বাইরে পা রাখলো সে। দুই হাত দিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছাতিম গাছের দুই ডাল ধরে কষে একটু দোল খেয়ে নিয়ে থামে মটকা। ডানে-বামে শরীরটা ঘুরিয়ে আচ্ছামতো ঘুরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে বলল, বাহ! আমাদের জঙ্গলটা কী সুন্দর! এদিক ওদিক তাকিয়ে অবাক হয় মটকা। 



একটু দূরেই কয়েকটা ছোট গাছ। মনে হচ্ছে ওরা একজন আরেকজনের গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছোট গাছের মাথায় কয়েকটা চড়–ই পাখি বাসা বানিয়েছে। লতাজাতীয় কোনো গাছের ছোট ছোট শুকনো ডাল, ধানের বিচালি আর খেজুরগাছের পাতা ছিড়ে নিয়ে এসে বানানো বাসাগুলো দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। কয়েকটা বাসায় চড়–ই পাখির ছানাগুলো উপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। ওদের ঠোঁটগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওরা চড়–ই পাখির ছানা নয়, একদল ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষর আকাশের দিয়ে তাকিয়ে ভি… ভি… করে চিৎকার করছে। ওদের চিৎকার শুনে মটকা জানতে চাইলো, কিরে তোরা অমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন?
মটকার কথা শুনে চিৎকার থামিয়ে একটা চড়–ইছানা বলল, চেঁচাচ্ছি কোথায়, আমরা তো গান করছি, মটকা দা। বলেই চড়–ইছানাগুলো আবার এক সাথে গান ধরলোÑ চিঁচি চিঁচি চিঁচিক…
ওদের এমন কোরাস গান গাওয়া দেখে মটকা বলল, তা হঠাৎ করে তোদের গান গাওয়ার কী এমন হলো শুনি?
সবচেয়ে ছোট্ট যে চড়–ইছানা সে বলল, আজ আমাদের অনেক মজার দিন, মটকা দা। অনেক দিন পর আমাদের মামণি পাশের গ্রামে খাবার আনতে গেছে। মজার সব খাবার। ফড়িংছানা, কেঁচো, চালের কণা আরো কতো কী। আমাদের জন্য মজার খাবার আনতে গেছে বলে আমরা এখন মামণির জন্য অপেক্ষা করছি আর গান করছি। চিঁচি চিঁচি চিঁচিক… চিঁচি চিঁচি চিঁচিক…
কোথা থেকে যেন একটা কাঠবিড়ালি লাফাতে লাফাতে এলো। মনে হচ্ছে ওর মুখে কিছু একটা আছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে এক লাফে একটা গাছে উঠে গেল সে। তারপর একটা বড় ডালের ওপর ব্যাঙের মতো পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে খুশিতে লেজ দোলাতে লাগলো। বুঝা গেছে ওর মুখে প্রিয় কোনো খাবার আছে আজ। মুখ থেকে গাছের ডালের ওপর খাবারটা নামালো সে। তারপর সামনের এক পা দিয়ে খাবারটা জুত করে ধরে রেখে সেও একটা গান ধরলোÑক্রি ক্রি ক্রিক… ক্রি ক্রি ক্রিক…
কাঠবিড়ালিটা মটকাদের ঘরের পাশেই একটা আমগাছের খোড়লে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে থাকে। মটকার সাথে প্রায়ই ওর দেখা হয়। মাঝে মধ্যে এক আধটু হাই-হ্যালোও হয়। কাঠবিড়ালির বোতলব্রাশের মতো ফুলো ফুলো লেজটা বেশ ভালো লাগে মটকার। তাই তো আদর করে মটকা কাঠবিড়ালিকে প্রায়ই কাঠু বলে ডাকে। মটকা দা’র মুখে নিজের এই ছোট্ট নামটা কাঠবিড়ালিরও খুব পছন্দ। সেই কাঠবিড়ালি মানে কাঠুর এমন খুশি খুশি ভাব দেখে মটকা ওকে বলল, কিরে কাঠু, খুব যে খুশি খুশি লাগছে। নতুন কিছু পেলি নাকি আজ?
কাঠু তার ফুলো ফুলো লেজটা দুদিকে দোলাতে দোলাতে বলল, পেয়েছি মানে, দারুণ জিনিস পেয়েছি, মটকা দা। রোজ আর ওই কাঁচা পেয়ারা নয়তো বরই খেতে আর ভালো লাগে না। গায়ে একটু সকালের রোদ লাগানোর জন্য আজ জঙ্গলের ওপাশের গ্রামটাতে ঘুরতে গিয়ে একটা বাদাম খুঁজে পেয়েছি, বুঝলে। একেবারে ভাজা বাদাম গো। কী যে মজা করে খাবো। বলেই কাঠু তার সেই মজার গানটা শুরু করলোÑ ক্রি ক্রি ক্রিক…
রোদের তেজ আরো বাড়ছে। মনে হচ্ছে দুপুর হয়ে আসছে। এমন সময় পাশের বাসার চাচা, মামদো ভূতের ছেলে চিচিংদোকে দেখা গেল। চিচিংদো মটকার খুব ভালো বন্ধু। সুযোগ পেলেই মটকাদের বাসায় মাছ নিয়ে আসে। দুই বন্ধু মিলে যা মজা করে মাছ খায়। মটকা মাছের কাঁটা বেছে খেলেও, চিচিংদো ওসবের ধারের কাছেও যায় না। যত বড়ো মাছই হোক চিচিংদো কাঁটাসহ কচকচ করে খেয়ে ফেলে। মাছ খেয়েই ও একটা অদ্ভুত কাজ করে। তেঁতুলগাছ থেকে তিনটা পাতা ছিড়ে নিয়ে পেটের ওপর দুই ডলা মেরে দেয়। এটা করলে নাকি গলায় কোনো কাঁটা আটকে থাকে না!
মটকাদের বাড়ির পাশেই একটা শেওড়াগাছে বাবার সাথে থাকে চিচিংদো। ওর মা একবার জঙ্গলের বাইরে দূরের একটা বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল। মাছ ধরে সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। সেদিন চিচিংদোর মায়ের সাথে দুই শাঁকচুন্নি ভূতও সেই বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল। ওরা কোনোমতে জঙ্গলে ফিরে আসতে পারলেও চিচিংদোর মা আর ফিরে আসতে পারেনি। শাঁকচুন্নিদের কাছে শুনেছে, পাশের গ্রামের জটাধারী এক ভূতের ডাক্তার তাকে ধরে বোতলে বন্দী করে রেখেছে! শাঁকচুন্নিদের কাছে এই ঘটনা শোনার পর থেকে দু পেয়েদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না চিচিংদো। কতদিন মায়ের সাথে দেখা হয় না। মায়ের জন্য তাই সব সময় মন খারাপ থাকে চিচিংদোর।
এহেন চিচিংদোকে মটকার মা হাতিভূত একেবারেই পছন্দ করে না। তার মতে, চিচিংদো হলো একটা বাজে টাইপের ভূত। সমাজে বাস করতে হলে সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। ময়মুরব্বিদের দেখলে সালাম দিতে হয়। তাদের সামনে দিয়ে চলার সময় ভদ্রভাবে চলতে হয়। কথা বলতে হয় নিচুস্বরে। কিন্তু চিচিংদো এসবের কিছুই করে না। সে ভূতসমাজের মুরব্বিদের পাত্তা তো দেয়ই না, সমাজের কোনো নিয়ম-কানুনও মেনে চলে না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে রেগে আগুন হয়ে যায়। যার তার সাথে মারামারি করে বেড়ায়। ওর থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকবি, চিচিংদো।
চিচিংদোকে আসতে দেখে ঘরের দরোজা থেকে একটু ভেতর দিকে সরে এলো মটকা। দরোজা থেকে একটু দূরে উপুড় হয়ে শুয়ে জঙ্গলের এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। চোখ বুজে ঘুমের ভান করে চিচিংদোকে নিয়ে একটু আগে মা যা বলল সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। মা হয়তো কারো কাছে কিছু শুনে চিচিংদো সম্পর্কে ভুল বুঝে আছে। কিন্তু চিচিংদো মোটেও ও রকম নয়। খামোখা সে কারোর সাথে মারামারি তো দূরের কথা, ঝগড়াও করতে যায় না। অকারণে কারো সাথে অন্যায় করা হচ্ছে দেখলে সে বরং রুখে দাঁড়ায়। কেউ বিপদে পড়েছে জানলে তার সাহায্যে এগিয়ে যায়। চিচিংদোর এই গুণটা ভীষণ ভালো লাগে মটকার। ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে বলে মনে মনে গর্বও করে সে।
মটকার মা যে চিচিংদোকে মোটেও পছন্দ করে না সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই তো রাতের বেলা ভুলেও মটকাদের বাসার দিকে যায় না চিচিংদো। সকাল হলে মটকার মা জঙ্গলের বাইরে দু পেয়ে ধরতে যায়। এই সময়টাতেই সে মটকাদের বাসায় আসে। কারণ মটকাকে ভীষণ ভালো লাগে চিচিংদোর। ওর কাছে অনেক কিছু বলা যায়। ও কারো কাছেই সে কথা বলে না। তাছাড়া মটকাটা বাইরের অনেক খবর রাখে। ওর কাছে এলে কতো কিছু যে জানা যায়। এই তো কয়েক মাস আগেই ও বলল, এখান থেকে বেশ দূরের এক মাঠের একেবারে মাঝখানে বিরাট এক বটগাছ আছে। প্রতি মাসের শেষ শনিবার ভরদুপুরে সেই বটগাছে ভূতদের একটা মেলা বসে। অনেক দূর থেকে নানান কিসিমের সব ভূত আসে সেই মেলায়। উফ! কতো যে মজা হয় সেখানে। নাচ-গান, লাঠিখেলা, ভয়দেখানি আরো কতো কী। একবার যাবে নাকি সেই মেলায়? মটকার কথা শুনে আমি তো অবাক। ভূতদের আবার মেলা হয় নাকি!
একবার কী হলো। মটকার মা দু’দিনের জন্য পাশের এক জঙ্গলে বেড়াতে গেল। এই তো সুযোগ। চিচিংদো তো সব সময়ই স্বাধীন। দু’দিনের জন্য এখন মটকাও স্বাধীন হয়ে গেল। কারণ মটকাকে মা সাথে করে নিয়ে যায়নি। মা ঘর থেকে বের হওয়ামাত্রই চিচিংদোর খোঁজে বের হলো মটকা। খুব বেশি সময় খুঁজতে হলো না। একটা ডোবার ধারে ডুমুরগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পানিতে ঢিল ছুড়ছিল। মটকা করলো কী, চুপি চুপি গাছের নিচে এসে চিচিংদোর ঝোলানো পা-টা ধরে নিজেও ঝুলতে লাগলো। এমন কাণ্ড দেখে চিচিংদো বলল, করিস কী, করিস কী। আমি পড়ে যাবো তো, পা-টা ছাড়।
চিচিংদোর পা ছেড়ে দিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো মটকা। ওর হাসি দেখে চিচিংদো বলল, মা বুঝি বাইরে গেছে, তাই না রে? উপর-নিচে মাথা দুলিয়ে মটকা বলল, দুই দিন বাসায় আসবে না মা! কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার।
গাছের ডাল থেকে এক লাফে নিচে নামলো চিচিংদো। মটকার ঘাড়ে হাত রেখে সে বলল, তাতে কি হয়েছে শুনি?
ঘাড় থেকে চিচিংদোর হাতটা সরিয়ে দিলো মটকা। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বলল, কি হয়েছে মানে? আজ যে মাসের শেষ শনিবার, জানিস না তুই? চল, আজ আমরা বটগাছের সেই ভূতমেলায় যাবো।
হঠাৎ ভূতমেলার কথা মনে পড়ায় চিচিংদো একেবারে লাফিয়ে উঠলো। খুশির চোটে ডিগবাজি খেয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে বলল, আর দেরি কেনরে, এখনি চল।
মটকার সাথে সেদিন সেই ভূতমেলায় গিয়ে সত্যিই অনেক মজা করেছিল চিচিংদো।
খুব বেশিক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারলো না মটকা। ভূত হয়ে কারো ভয়ে এভাবে ঘরে বসে থাকা যায়? গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জঙ্গলের পেছন দিকটার আমগাছের খোড়লে কী আছে আজ তাকে দেখতেই হবে। দুপুরের এই সময়টা চিচিংদোর সাথে একটু খেলতে না পারলে হাত-পায়ে কেমন যেন জ্বালা করে! মাথা ঘুরে বমি বমি ভাব হয়! কাঠুর সাথেও একটু দুষ্টুমি করা দরকার। মজার বাদাম কি শুধু ও একাই খাবে নাকি?
ঠিক করেছে এখন থেকে আর মায়ের সব কথা শুনবে না মটকা। এখন কী আর ও ছোট আছে নাকি? ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে না! ও এখন একাই জঙ্গলের সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারে। চিচিংদোকে সাথে নিয়ে ভূতের মেলায় যেতে পারে। এ-গাছ ও-গাছের ডালে ডালে বাঁদরঝোলা ঝুলতে পারে। পাতায় পাতায় ঘুরে কাঠুর সাথে খেলাও করতে পারে।
একদিনের ঘটনা। ছেলের জন্য দু পেয়ে বাচ্চামানুষ ধরতে খুব ভোরের দিকে ঘর ছাড়লো হাতিভূত। যাওয়ার সময় মটকাকে এটা করো না, ওটা করো না বলে শাসিয়ে গেল। কিন্তু মটকা আজ ওসব শুনলে তো। মা ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই সে বাইরে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই চোখ পড়লো দূরের একটা দেবদারু গাছের দিকে। ওদিকে তাকিয়ে ভাবলো, আকাশছোঁয়া ওই গাছটার মাথায় কী আছে আজ তাকে দেখতেই হবে।
লম্বা পায়ে থপ থপ আওয়াজ তুলে দেবদারু গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো মটকা। চোরাচোখে চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। না, আশপাশে আর কোনো ভূত নেই। শুধু ছোট-বড় অনেক গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো গাছের পাতা সবুজ, কোনো গাছের পাতা হালকা হলুদ। হলুদ পাতাঅলা গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলছে আর র্স র্স সুর করে গান করছে। আর সবুজ পাতাঅলা গাছের কচিপাতাগুলোর ওপর সকালের রোদ নেচে নেচে খেলা করছে। দেবদারু গাছের কাছ থেকে একটু দূরে এসে ছোট গাছগুলোর নিচে দাঁড়ালো মটকা। গাছের নিচে চুপ করে দাঁড়াতেই পাখিদের কিচিরমিচির গান শুনতে পেল সে। কী মিষ্টি গান! সকালে পাখিদের এমন কিচিরমিচির গান শুনে মনটা এক অন্য রকম ভালোলাগায় ভরে গেল তার।
দেবদারুগাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালো মটকা। অনেক লম্বা গাছ। এই গাছগুলো এতো লম্বা হয় কেন? কেউ যাতে ওর ডাল ভাঙতে না পারে সেজন্য? নাকি আকাশের ওপারে গিয়ে কারো সাথে মিতালি করতে চায় বলে সে জন্য? সাড়ে তিনবার মাথা চুলকিয়েও কোনো উত্তর খুঁজে পায় না মটকা। উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে টুকুস করে দেবদারু গাছের মাথায় উঠে যায় সে। এখন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারলো না। এদিকে যাই, ওদিকে যাই করে শেষ পর্যন্ত উত্তর দিকে হাঁটা দিলো। জঙ্গল শেষ হয়ে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। মাঠ দেখে কম করে হলেও তিনবার ডিগবাজি খেলো মটকা। আরে, এদিকটা তো দেখি অনেক সুন্দর! ফসলের মাঠ আছে, মাঠে মাঠে অনেক সবজি চাষ হয়। একটু দূরেই কয়েকটা খরগোশ মিলে গাজর খাচ্ছে। ওদের গাজর খাওয়া দেখে মটকা ভাবলো, জিনিসটা নিশ্চয় অনেক টেস্টি। খেতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু আমার তো গাজর খেতে মানা। মা বলেছে, এই জঙ্গলের কোনো ভূত মাছ ও দু পেয়েদের ঘাড় মটকে রক্ত খাওয়া ছাড়া আর কিছু খায় না।
ভূত হওয়ার আগে জঙ্গল পার হয়ে মাঠের ওদিকে যাওয়া মোটেই নিরাপদ ভাবলো না মটকা। মাঠের দিক থেকে ফিরে জঙ্গল যেদিকে বেশি ঘন ও অন্ধকার মটকা এবার সেদিকে গেল। ভূত বা ভূতের নাতিপুতিরা কোনো কিছু দেখে ভয় পায় না। এমনটা হলে ওদেরকে ভূতসমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু একটা উড়ে এসে পড়ায় মটকা একটু চমকে উঠলো। জিনিসটা কোথা থেকে এসে পড়লো সেটা দেখার জন্য ওপরের দিকে তাকাতেই অবাক হলো মটকা। ওর চমকে ওঠা দেখে কয়েকটা বানর দাঁত বের করে হাসছে। হাসতে হাসতে এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে অন্য গাছে যাচ্ছে। লাফের ফাঁকে ফাঁকে লম্বা লেজ দিয়ে গাছের ডাল পেঁচিয়ে ধরে বাদুড়ঝোলা হয়ে কেউ ফল খাচ্ছে তো কেউ ভেংচি কাটছে। ওদের এমন কাণ্ড দেখে মটকার পিত্তিটা একেবারে জ্বলে গেল!
সামনে এগোতেই আরেকটা খোলা মাঠ চোখে পড়লো। মাঠ ভরা কী সুন্দর সবুজ ঘাস। দু-একটা ঘাসে নানান রঙের ফুল ফুটেছে। মধু সংগ্রহের জন্য কয়েকটা মৌমাছি এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঠের এখানে ওখানে নানান রঙের ফড়িং বাতাসে নেচে নেচে ছোট ছোট পোকা ধরে খাচ্ছে।
মটকা এতদিন মনে করতো তাদের ঘরটাই সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু জঙ্গলের সবখানে এতসব মজার জিনিস আছে দেখে তার মনে হলো এই জঙ্গলটাই সবচেয়ে সুন্দর। মটকা বুঝতে পারছে না, এ সুন্দর একটা জঙ্গল মামণি কেন তাকে ঘুরে দেখতে দেয় না? তার মনে হলো, পুরো জঙ্গল ঘুরে দেখতে পারলে হয়তো আরো অনেক কিছু দেখা যাবে। কিন্তু আজ দুপুর হয়ে আসছে। একটু পরেই মা ঘরে ফিরবে। মটকা তাই ভাবলো, আজ বরং ঘরে ফিরে যাই, কাল আবার আসা যাবে।
এতো সময় ঘোরাঘুরির কারণে সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি মটকার। মামণি কখন আসে তারও কোনো ঠিক নেই। পেটে কিছু দেয়ার জন্য এখন কিছু মাছ পেলে মন্দ হতো না। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো পাশেই একটা ছোট খাল আছে। তালগাছের মতো লম্বা লম্বা ঠ্যাং নিয়ে খালের পানিতে নেমে পড়লো সে। দু-চার বার পানির নিচে হাত চালাতেই একটা শোলমাছ পেয়ে গেল। আর মাছ ধরার চেষ্টা না করে ভাবলো, ছোট ভূতের পেট, এক মাছেই ভরে যাবে। ভূত হলেও মটকা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাম হাতে কুচুরিপানাগুলো এক পাশে সরিয়ে দিতেই টলটলে পানি দেখা গেল। ডান হাতে ধরা মাছটা মানুষের পচাপাট ধোয়ার মতো করে পানিতে কয়েকবার ধুয়ে নিলো। তারপর পেটে চালান করে দিলো।
মাছ খেয়ে উপরে উঠে আসার সময় কেমন যেন একটা শব্দ এলো মটকার কানে। শব্দটা খুব বেশি দূরে হচ্ছে বলে মনে হলো না। আশপাশেই কোথাও হবে হয়তো। কিন্তু শব্দটা কিসের? কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো মটকা। একটু শুনেই বুঝতে পারলো শব্দটা এই জঙ্গলের কোনো প্রাণীর বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এমন শব্দ সে আগে কখনো শোনেনি।
শব্দটা ক্রমেই মটকার কাছাকাছি আসছে বলে মনে হচ্ছে। মর মর, মর মর। বেশ মিষ্টি শব্দ তো! এমন চমৎকার শব্দ তুলে কোনো প্রাণী এই জঙ্গলে চলতে পারে! মটকা ভীষণ অবাক হলো। মায়ের কথা শুনে সব সময় ঘরে বসে থাকায় জঙ্গলের কোনো কিছুই ভালো করে জানা হয়নি দেখে নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হলো মটকার। সে আর বোকা থাকতে চায় না। এখন থেকে সুযোগ পেলেই জঙ্গলে ঘুরতে বেরোবে। কোথায় কী আছে সব জেনে নেবে।
হঠাৎ করেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। মটকা এটার কোনো কারণ বুঝলো না। তবে এটা বুঝতে পারলো শব্দটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আশপাশের গাছে গাছে থাকা পাখিরা ভয়ে চিৎকার করছে। বানরগুলো এমন চেঁচামেচি করছে। মনে হচ্ছে পুরো জঙ্গলটা ওরা আজ মাথায় তুলে ফেলবে। ওরা সবাই কেন এমন ভয় পাচ্ছে, মটকা কিছুই বুঝতে পারছে না। ওরা কী তাহলে আমার মতো একটা বাচ্চাভূতকে দেখে… ধ্যেৎ, তা হবে কেন? ওদের সাথে তো আমার প্রায়ই দেখা হয়। কই, আগেতো ওদের কেউ এমন চিৎকার-চেঁচামেচি করেনি। ধুর, ওরা যা করার করুক। আমি ঘরে ফিরে যাই।
পেছন ফিরে সামনে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মটকার। পাখি আর বানরদের ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করার কারণটা বুঝতে পারলো সে। একটু দূরেই শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে জটাধারী দু পেয়ে এক জন্তু। এতক্ষণে বুঝা গেল, শুকনো পাতার ওপর এই জন্তুটার পা পড়ার কারণেই মর মর শব্দ শোনা গেছে। দু পেয়ে জন্তুটার পিঠে ইয়া বড়ো একটা ঝোলা। গলায় নানান রকম পুঁতির মালা। গায়ে ছেড়া পাঞ্জাবি। ভীষণ ময়লা। হাতে হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা একটা লাঠি। কোমরে ঝুলছে নানান সাইজের প্লাস্টিকের বোতল। কোনোটা বড়ো, কোনোটা ছোট। দু পেয়ে জন্তুটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। দু পেয়ে জন্তুটা নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু হবে। না হলে, ওটাকে আসতে দেখেই জঙ্গলের পাখি আর বানরগুলো এমন চিৎকার চেঁচামেচি করলো কেন? কী করবে কিছুই ভাবতে পারছে না মটকা। ঝেড়ে দৌড় দেবে? নাকি জন্তুটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে?
দু পেয়ে জন্তুটাকে ভয় দেখানোর কথাই ভাবলো মটকা। জন্তুটা কাছাকাছি আসার আগেই মটকার মাথায় লম্বা দুটো শিং গজিয়ে গেল। ওকে এখন রাগে ফোঁস ফোঁস করা ষাঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। শিংঅলা মাথাটা বাম-ডানে আচ্ছামতো কয়েকবার ঝাঁকালো মটকা। সাথে সাথে ওর চোখ দুটো অনেক বড়ো হয়ে গেল। মুখের ভেতরের দুই পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো তলোয়ারের মতো লম্বা দুটো দাঁত। একটু গা ঝাড়া দিয়ে জলহাতির মতো বিশাল হাঁ করে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকলো মটকা।
দু পেয়ে জন্তুটা মটকাকে দেখে মোটেও ভয় পেল না। হাতে থাকা হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা লাঠিটা আকাশের দিকে উচুঁ করে ধরে বিড় বিড় করে কী যেন বলল দু পেয়ে জন্তুটা। অমনি লাঠি থেকে রঙবেরংয়ের আলোর রেখা বেরিয়ে মটকার গায়ে এসে লাগলো। আলো এসে গায়ে লাগতেই মটকার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। মনে হচ্ছে ওর চারপাশের সবকিছু চরকার মতো ঘুরছে। একটু পরে মটকা নিজেও লাটিমের মতো ঘুরতে লাগলো। এমনটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভয় পেল মটকা। ওর সবকিছু আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে যে! সামনের দিকে তাকালো মটকা। দেখলো, সেই দু পেয়ে জন্তুটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখা একটা বড়ো বোতল বের করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এই সময় গাছের পাখি আর বানরগুলো আরো জোরে চেঁচামেচি শুরু করলো। ওদের এ রকম চেঁচামেচি শুনে মটকা বুঝতে পারলো, ও বড়ো রকমের কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে।
গায়ের সব শক্তি এক করে আকাশ ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলো মটকা। মামণি! মামণি! ও মামণি…! বাঁচাও… কিন্তু এতো জোরে চিৎকার দিলেও ওর গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। আজ কী হলো মটকার। এমন হচ্ছে কেন?
দেখতে দেখতে দু পেয়ে জন্তুটা আরো কাছে চলে এসেছে। পেছন ফিরে ঝেড়ে একটা দৌড় দিতে চাইলো মটকা। কিন্তু পা দুটো মাটি থেকে উঠাতেই পারলো না সে! মনে হচ্ছে কেউ একজন সিমেন্ট-বালু দিয়ে ওর পা দুটো মাটির সাথে চিরদিনের মতো আটকে দিয়েছে! গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই মনে হচ্ছে।
সামনে ঘোর বিপদ। এই ঘোর বিপদে হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়লো মটকার। মা বলে, ছোটরা বিপদ দেখলে ভয় পেয়ে যায়। বিপদ থেকে কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়, তা তারা বুঝতে পারে না। এই জন্য মা-বাবা যখন ঘরে থাকে না তখন ছোটদের কখনোই বাইরে আসা ঠিক নয়।
এখন কোনো কিছু ভাবনা-চিন্তা করার সময় নেই। বাঁচতে হলে যা করার এখনি করতে হবে। তাই করলো মটকা। বাঁচার আশায় শেষবারের মতো ভয়ঙ্কর এক চিৎকার দিলো সে। এমন জোরে চিৎকার দিলো যে আগুন নেভানো গাড়ির চিৎকারও ফেল মেরে গেল! ওর চিৎকার শুনে গাছের ডালে ঘুমিয়ে থাকা একটা বেবুনের বাচ্চা নিচেয় পড়ে গেল। গাছের পাখিরা ভয়ে দূরে উড়ে গেল। পোকা খাওয়া বাদ দিয়ে পালাতে লাগলো ফড়িংয়ের দল।
চিচিংদো।দূরেই একটা গাব গাছের ডাল ধরে আরামসে দোল খাচ্ছিলো। দুনিয়া কাঁপানো এমন চিৎকার শুনে ওরও দোল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পেটের ভেতরে এখনো কেমন কেমন করতে থাকলেও বসে থাকতে পারলো না চিচিংদো। কারণ একটু আগে যে মরণ চিৎকার সে শুনেছে সেই চিৎকারটা কার সেটা তার জানা হয়ে গেছে। জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে তার প্রিয় বন্ধু মটকা নিশ্চয় ভয়ানক কোনো বিপদে পড়েছে। দোল খাওয়া বাদ দিয়ে এক লাফে একটা তেঁতুল গাছের মগডালে উঠে গেল সে। বাতাসের গন্ধ শুঁকে বুঝতে চেষ্টা করলো চিৎকারের শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। তারপর শব্দের উৎস ধরে জঙ্গলের গাছেদের উপর লম্বা লম্বা পা ফেলে আড়াই মিনিটের মধ্যেই মটকার কাছে পৌঁছে গেল চিচিংদো।
মটকার সামনে জটাধারী দু পেয়ে জন্তুটাকে দেখেই ভয়ানক রেগে গেল চিচিংদো। রাগের চোটে বারকয়েক নিজের হাতেই চিমটি কাটলো সে। একটা গাবগাছের মাথা ধরে জোরসে ঝাঁকুনি লাগালো। তাতেও রাগ পুরোপুরি মিটলো না তার। ভালো করে তাকালো জন্তুটার দিকে। পিঠে প্রায় মাটি পর্যন্ত একটা লম্বা ঝোলা ঝুলানো। ডান হাতের মুঠিতে হরিণের শিংয়ের মতো লম্বা লাঠি দেখেই দু পেয়ে জন্তুটাকে চিনতে পারলো চিচিংদো। এই জন্তুটাই হলো সেই দু পেয়ে ভূতের ডাক্তার! বাবার মুখে ওর কথা অনেকবার শুনেছে। চিচিংদো তখন অনেক ছোট। দিনদুপুরে কিংবা ভরসন্ধ্যায় কী করে মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত খেতে হয় সেটা তখনো শেখা হয়ে ওঠেনি। এক আধটু গাছে উঠে ছোটখাটো ডাল ধরে ঝাঁকুনি দিতে পারে এই যা।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাছ খাওয়ার জন্য ভয়ানক কান্না শুরু করলো চিচিংদো। এমন কান্না, মনে হয় ওর বাবা-মা কেউ বাসায় নেই। শুধু কান্না করলে সমস্যা ছিল না। কান্নার সাথে সাথে একবার বাবার হাতে কামড় মারে তো একবার মায়ের হাতে কামড় মারে। এতো কামড় আর কাহাতক সহ্য হয়। শেষে ওর মা বলল, ঠিক আছে, এখনকার মতো এই দুষ্টু বাচ্চাটার মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে নে! তারপর কাল সকালে তোকে মাছ এনে দেবো।
ছেলের বায়না মেটানোর জন্য একদিন খুব সকালবেলা জঙ্গলের বাইরে দূরের এক বিলে চিচিংদোর জন্য মাছ ধরতে গিয়েছিল মা। কী যে দিনকাল হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও একটা বড়ো মাছ ধরতে পারলো না সে। কার কাছে যেন শুনেছে, এখন ফসল চাষে নানান রকম বিষ ব্যবহার করা হয়। এই সব বিষের বেশির ভাগ অংশ বৃষ্টির পানি আর সেচের মাধ্যমে নাকি খাল-বিলে এসে হাজির হয়। বিষ মেশানো এই সব পানি মাছেরা নাকি একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ফলে দিন দিন খাল-বিল থেকে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে! দু পেয়ে জন্তুগুলো যে কতো বোকা সেটা ভেবে খুব হাসি পায় মামদো ভূতের। আরে, তোদের নিজেদের জন্য হলেও তো মাছ রক্ষা করতে হবে।
দু’বারের মাথাতেই কয়েকটা পুঁটি আর ছোট দুটো টাকি পেয়ে গেল। অনেক বেলা হয়েছে। সকাল থেকে চিচিংদোর পেটে কিছুই পড়েনি দেখে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার চেষ্টা করলো। ফিরে আসার সময় একটা বটগাছের ডালে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক এই সময় এই জটাধারী ভূতের ডাক্তারটা বটতলায় একটা গামছা বিছিয়ে তার ওপর বসে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বদ এই দু পেয়েটা গাছের ডালে কিছু একটা বসার শব্দ এবং তাজা মাছের গন্ধ পেয়ে উপরের দিকে তাকাতেই মাকে দেখে ফেলে। ব্যস, আর যায় কোথায়। মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু পেয়ে ডাক্তার জন্তুটা তাকে বোতলবন্দী করে ফেলল!
সেদিন অন্যায়ভাবে মাকে বোতলবন্দী করায় দু পেয়ে ডাক্তার জন্তুটাকে সামনা সামনি পেয়ে মাথার চান্দি গরম হতে লাগলো চিচিংদোর। চান্দিটা ফটাস করে ফুটে যায় কি-না সেই চিন্তায় লম্বা হাত দুটো বাড়িয়ে পাশের এক মরা পুকুর থেকে কয়েক খাবলা পানি এনে মাথা ভেজাতে লাগলো! মাথায় পানির ছিটা দেয়ায় ঝামেলা আরো বাড়লো। রাগের চোটে ওর পেট ফুলতে লাগলো। দুই চোখ থেকে হয়ে গেল তিন চোখ! চোখগুলো এমন বড় আর লাল হতে লাগলো যে, মনে হলো সব চোখ থেকে এখনি আগুনের গোলা বের হয়ে আসবে! চিচিংদোর হাত-পাগুলোও লম্বা হতে লাগলো। লম্বা হতে হতে এক সময় তালগাছ ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলল।
সামনে হঠাৎ চিচিংদোকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মটকা। প্রিয় বন্ধুকে সামনে পেয়ে আনন্দে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল মটকা। ওর এমন কান্না দেখে চিচিংদো বলল, শাঁকচুন্নিদের মতো এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিসনে তো মটকা। জঙ্গলবাড়ির কোনো ভূত কিংবা ভূতের পুত কখনোই কাঁদে না। চিচিংদো রাগে পেট ফোলাতে ফোলাতে বলল, দু পেয়ে বদমাস, তোর কতো বড়ো সাহস। লাঠি, ঝোলা আর বোতল সাথে নিয়ে আজ একেবারে আমাদের জঙ্গলেই ঢুকে পড়েছিস? আজ তোর ডাক্তারিটা ভালো করেই শেখাবো, দাঁড়া। এমন শিক্ষা দেবো যে…
দু পেয়ে জন্তুটা সেই তখন থেকে চিচিংদোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ফাঁকে একটু বাঁক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মটকা। এখন আর ভয় করছে না তার। মটকাকে বোতলবন্দী করার জন্য জটাধারী বুড়ো যে বোতলটা বের করেছিল, সেটা আবার কোমরে ঝোলাতে গেল। মাথা নিচের দিকে থাকায় চিচিংদো কিংবা মটকা কারোর দিকেই বুড়োর এই সময় নজর ছিল না। সুযোগটা ভালোমতোই কাজে লাগালো চিচিংদো। জটাধারী বুড়োর হাত থেকে এক টান দিয়ে হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা সেই লাঠিটা কেড়ে নিলো। তারপর লম্বা দুই হাত দিয়ে লাঠিটা মাঝখান থেকে মটাস করে ভেঙে ফেলল।
অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটলো। হঠাৎ ছোট হয়ে যাওয়া মটকা আবার বড়ো হয়ে গেল! বুঝতে পারলো, বুড়োর লাঠিটা ভেঙে ফেলার পরই এমনটা হয়েছে। তার মানে জটাধারী বুড়ো শয়তানের ওই লাঠির মধ্যে কোনো জাদুটাদু ছিল! সেটার জোরেই বুড়ো মটকাকে ছোট করে ফেলেছিল। লাঠিটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে ভালোই করেছে চিচিংদো।
লাঠিটা হারিয়ে ভূতের ডাক্তার নামধারী বুড়ো জটাধারী কেমন যেন করতে লাগলো। পিঠে ঝুলানো লম্বা ঝোলার মধ্যে গরুর কয়েকটা শিং থাকলেও সেগুলো বের করার কোনো সুযোগই পেল না বুড়ো। কারণ তার সামনে এখন জঙ্গলবাড়ির দুই বিশালদেহী ভূত দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠা মটকা বুড়ো জটাধারীর পিঠের ঝোলাটা একটানে কেড়ে নিলো। দূরে কোথাও ফেলে দেয়ার আগেই মটকার হাত থেকে এক থাবায় সেটা কেড়ে নিলো চিচিংদো। বিশাল এক হাঁ করে পুরো ঝোলাটা সেই হাঁ করা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো সে। পেটের ওপর হাত বুলাতেই ঝোলাটা হজম!
ঝোলা হারিয়ে বুড়ো জটাধারী একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। কোমরে ঝুলিয়ে রাখা বোতলগুলো একের পর এক জঙ্গলবাড়ির সেই পুরনো পুকুরে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। কারণটা বুঝতে পেরেই চিচিংদো বুড়ো জটাধারীর গলা ধরে উঁচু করে ফেলল। দু পেয়ে জন্তুগুলো একদিন মটকার মাকে যেভাবে পিটিয়েছিল, পেটানোর পর শুঁড় ধরে একটা গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলেছিল, চিচিংদোও তাই করলো। বুড়ো জটাধারীর কোমর থেকে বোতল খুলে নিয়ে আচ্ছামতো বোতলথেরাপি দেয়া শুরু করলো। তারপর দুই হাত ধরে একটা গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে শিড়দাঁড়াটা মট করে ভেঙে দিলো বুড়োর।
সব বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলে দিতে লাগলো চিচিংদো। যে আশায় সে বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলছে সেটা পূরণ হচ্ছে না দেখে হতাশায় মুখটা কালো হতে লাগলো তার। আকাশ কাঁপানো এক চিৎকার দিয়ে বাকি বোতলগুলো একটা গাছের গুঁড়ির ওপর সজোরে আছাড় মারলো চিচিংদো। আর ঠিক তখনি একটা ভাঙা বোতলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক বুড়ি। এতো বছর পরে মাকে চিনতে একটুও ভুল হলো না চিচিংদোর। এই বুড়িটা আর কেউ নয়, তার প্রিয় মা, মামদো ভূত। মা-ছেলে অনেকক্ষণ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। তারপর মায়ের বুক থেকে মুখ সরিয়ে মটকার দিকে তাকাতেই দেখলো, দূরে দাঁড়িয়ে হাতিভূতটা পাতালি দিচ্ছে!