জঙ্গলবাড়ির ভূত



এক ছিল বাগানবাড়ি। এই বাগানবাড়িতেই কোনো এককালে এক জমিদারের আলিশান বাড়ি ছিল। বাড়ি তো নয় যেন এক চোরাকুঠুরি। নতুন কেউ সেই বাড়িতে একবার ঢুকলে দ্বিতীয়বার ঢুকতে চাইতো না। বিশাল সেই বাড়িতে এতো সব ঘর আর অলিগলি পথ ছিল যে জমিদারের লোকদের সাহায্য ছাড়া বাইরে বের হওয়া ভারী কঠিন ছিল। বিশাল বাগানবাড়ির এখানে ওখানে ছিল বেশ কয়েকটা পুকুর। নানান ঘটনার সাক্ষী সেই বাগানবাড়িটা এখন আর আগের মতো নেই। থাকবে কী করে, জমিদার বাবু মরে যাওয়ার পর তার ছেলেমেয়েরা কেউ আর ও-বাড়িতে থাকতো না। যে যেদিকে পেরেছে চলে গিয়েছিল। এ-কাজ সে-কাজ নিয়ে এক সময় জমিদার বাড়িতে যাদের আসা-যাওয়া ছিল তারাও আর কেউ এ-মুখো হতো না। একটা সুন্দর তকতকে ঝকঝকে বাড়িতে বহু বছর কেউ না থাকলে বা তার যতœ-আত্তি না নিলে যা হয় আরকি।
জায়গায় জায়গায় শ্যাওলাধরা ইট খসে যাওয়া দেয়াল আর উঁচু ঢিবি ছাড়া ওই বাগানবাড়িতে এখন আর কিছু নেই। আশপাশের মানুষের কাছে এককালের বাগানবাড়িটা তাই এখন জঙ্গলবাড়ি হিসেবে পরিচিত। দিনে দিনে এখানে যে কতো গাছপালা জন্ম নিয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িটা এখন ভয়ঙ্কর সব সাপ, নানান রকম পাখি আর বন্যপ্রাণীদের আবাস হয়েছে। ওই বাড়িতে এই আছে সেই আছে বলে, মানুষের মুখে নানান রকম কাহিনীও শোনা যায়।
জমিদারের বাগানবাড়ি মানে এখন যেটা জঙ্গলবাড়ি আরকি, সেই জঙ্গলবাড়ির পাশেই ছিল একটা ছোট্ট গ্রাম। নাম অভয়ডাঙা। অভয়ডাঙা থেকে মাইল কয়েক দূরেই ছিল একটা পাহাড়। শোনা যায়, বুনো হাতি আর অজগর সাপের ভয়ে ওই পাহাড়ের ধারে কাছেও কেউ যেত না। একবার নাকি ওই পাহাড় থেকে অভয়ডাঙা গ্রামে একটা হাতি ঢুকেছিল। পাগলা মেয়ে হাতি। পাগলা হাতি বন ছেড়ে হঠাৎ গ্রামে ঢুকে পড়লে যা করে আর কি। গ্রামে ঢুকেই মানুষের বাড়িঘর ভাঙা শুরু করলো সে। সামনে যাকে পায় তাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে গাছের সাথে এক বাড়ি মেরে পরপারে পাঠিয়ে দেয়। কখনো কখনো পায়ের তলায় ফেলে বেলুন ফোটানোর মতো ফটাস করে ফুটিয়ে দেয়। পাগলা হাতির এমন কায়কারবার দেখে গ্রামের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করলো।
অভয়ডাঙা গ্রামে গোঁয়ার টাইপের এক লোক বাস করতো। নাম ছিল মনা। গ্রামের কাউকে জমা দিয়ে চলতো না সে। নিজে যখন যা মনে করতো তাই করে যেত। তার এমন কাণ্ড দেখে গ্রামের লোকেরা তাকে মনা পাগলা নামে ডাকতো। তো, হাতির ভয়ে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পালিয়ে গেলেও মনা পাগলা কিন্তু পালালো না। পাগলা হাতিটাকে এক হাত দেখে নেবে বলে একদিন নিজের বাড়ির সামনের উঠোনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকলো সে। একটু পরেই চারপাশে শোরগোল উঠলো। কে কোথায় আছো, পালাও… গ্রামে পাগলা হাতি ঢুকেছে। শোরগোল শুনে আশপাশে তাকালো মনা পাগলা। দেখলো পাগলা হাতিটা ওর বাড়ির দিকেই আসছে। দেখতে দেখতে হাতিটা বাড়ির খোলাটে এসে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে সবাই হায় হায় করতে লাগলো। পাগলাটা সত্যিই সরলো না ওখান থেকে, আজ তো ওকে পায়ের তলায় ফেলে একেবারে পিষেই মারবে!


মনা পাগলা হাতির ভয়ে দৌড় দেয়া তো দূরের কথা এক চুল নড়লোও না জায়গা থেকে! হাতিটা কাছাকাছি আসতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। লুঙ্গিটা ভালো করে মালকোছা মেরে শক্ত করে মুঠ পাকিয়ে দাঁড়ালো। চোখের পলকে এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মহিষ যেমন গোঁয়ারের মতো হঠাৎ রুখে দাঁড়ায়। মনাও তাই করলো। পাগলা হাতিটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শুঁড় ধরে চরকার মতো মাথার চারপাশে ঘুরাতে লাগলো। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হাতির তো কম্ম সারা। আজ এ কার পাল্লায় পড়লামরে বাবা। সবাইকে আমিই শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আচ্ছামতো ঘুরিয়ে… আর আজ আমাকেই কিনা একটা দু পেয়ে…
মাথার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হাতিটার প্রায় বমি এসে গেল। মনে হলো, সকালের দিকে খাওয়া কলাগাছ আর বেলগুলো পেট থেকে এখনই গরগর করে বেরিয়ে আসবে। হাতির পেটের খবরটা মনা পাগলা বুঝতে পেরেই হঠাৎ ঘুরানো বন্ধ করে শুঁড়টা ছেড়ে দিতেই অনেক দূরের এক গাছে গিয়ে বাড়ি খেয়ে মাটিতে সেই যে পড়লো আর উঠলো না।
মনা পাগলার হাতে হাতি মারার এই খবরটা এ-কান ও-কান হয়ে আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। মরা হাতিটাকে এক নজর দেখার জন্য আশপাশের গ্রামের লোকজন বানের পানির মতো অভয়ডাঙায় ছুটে আসতে লাগলো। লোকজনের সেই ভিড় থেকে কে যেন একজন বললো, অভয়ডাঙার মনা পাগলার সাহস আছে বটে। বেটা শুঁড় ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে একটা হাতি মেরে ফেললো! কে বলে এটা অভয়ডাঙা গ্রাম। এটা তো দেখছি হাতিমারা গ্রাম! ব্যস, সেই থেকে গ্রামটাকে আর কেউ অভয়ডাঙা নামে ডাকে না। আশপাশের গ্রামের সবার মুখে অভয়ডাঙা গ্রামের নাম এখন হাতিমারা!
তো এই হাতিমারা গ্রামের লোকজনও কোনোদিন জঙ্গলবাড়িতে পা রাখার সাহস করেনি। কারণ, ওই জঙ্গলে ঢুকলে নাকি কেউ বের হয়ে আসতে পারে না! কথাটা সত্য নাকি স্রেফ গালগপ্প সেটা জানার জন্য নানান বয়সের অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি। সবার সাথে কথা বলে যেটা জানা গেল সেটা হলো এর আগে রান্নার কাঠ কিংবা গাছের ফলমূল সংগ্রহের জন্য অনেকেই জঙ্গলবাড়িতে ঢুকেছিল। এ পর্যন্ত যারা ওই জঙ্গলে ঢুকেছে তাদের কেউ নাকি বাড়ি ফিরে আসেনি!
সাত পুরুষ ধরে সবাই লোকমুখে শুনে আসছে, বহু বছর আগে মনা পাগলা নামে একটা লোক যে পাগলা হাতিটাকে মেরে ফেলেছিল, সেই পাগলা হাতিটা এক সময় ভূত হয়ে গিয়েছিল। ভূত হওয়ার পর থেকে সে ওই জঙ্গলবাড়িতেই আছে। সুযোগ পেলেই সে নাকি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়। কাঠ বা ফলমূল সংগ্রহের জন্য যারাই জঙ্গলবাড়িতে ঢোকে তাদেরকেই ঘাড় মটকে রক্ত খায়। রক্ত খাওয়ার পর দু পেয়েদের হাড়গোড় আর মাথার চুল পাশেই ফেলে রাখে হাতিভূতটা!
হাতিমারা গ্রামের অনেকের ধারণা, হাতিভূতের একটা পুত আছে। তার নামটাও জেনে ফেলেছে তারা! হাতিভূতের পুতের নাম হলো মটকা। মায়ের সাথে মটকাও এই জঙ্গলে থাকে। বাগে পেলে সেও বাবার সাথে দু পেয়ে জন্তুদের ঘাড় মটকে রক্ত খায়! একদিন দু পেয়ে কারো ঘাড় মটকাতে না পারলে নাকি মটকার মাথা গরম হয়ে যায়। তখন সে নিজেই নিজের হাত-পা চিবিয়ে খাওয়া শুরু করে। আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে থাকে।
কিন্তু হাতিভূত আর তার ছেলে মটকা মোটেও ওরকম কিছু করে না। জঙ্গলবাড়িতে ঢুকে কেউ যাতে ওদের দেখতে না পায় সে জন্য ওরা গাছের ডালে ঝুলে না থেকে বড় কোনো গাছের নিচে সুড়ঙ্গ করে থাকে। সুড়ঙ্গটা দেখতে ঠিক মানুষের বাড়ির মতো। বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো রুম আছে বাড়িটায়। এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়ার জন্য অনেক দরোজাও আছে। প্রত্যেকটা রুমের ছাদে কিসের যেন কঙ্কাল ঝুলানো। মটকা সারাদিন এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়ে বেড়ায় আর কঙ্কালগুলো নিয়ে খেলা করে।
সব ভূত শিকার ধরার জন্য রাতবিরাতে বের হলেও হাতিভূত সেটা করে না। ওই সময় সে মটকাকে বুকের মধ্যে নিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায়। সকাল হলেই বাইরে বেরিয়ে যায়। জঙ্গলের এখানে ওখানে ঘুরে দু-একটা দু পেয়ে জন্তু ধরে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। মটকা নিজের ঘরে বসে সেই জন্তুগুলোর ঘাড় মটকে রক্ত খেতে খেতে মায়ের কাছে জানতে চায়, এই জন্তুগুলোর নাম কী মা? এদের রক্ত কিন্তু দারুণ টেস্টি!
মায়ের কাছে একটা আবদার করলো মটকা। বলল, মা, তুমি যে সব দু পেয়ে জন্তুগুলো ধরে আনো সেগুলোর অনেক বয়স। ওদের ঘাড় মটকে খুব একটা রক্ত পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওদের গায়ের হাড়গুলোও কেমন পাথরের মতো শক্ত। চিবাতে গেলে আমার মাড়ির দাঁতগুলো মরমর করে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি আমার দাঁতগুলো ভেঙে গেল। এই সব বুড়ো দু পেয়ে জন্তুগুলোর রক্ত খেতে আর ভাল্লাগে না মা। মাঝে মধ্যে দু-একটা দু পেয়ে জন্তুর ছানাপোনা নিয়ে এসো না। ভালো হয় যদি হাড়ে হাড়ে দুষ্টু আর যেগুলো মোটেই পড়ালেখা করতে চায় না এমন ছানাপোনাদের ধরে আনতে পারো। ওদের শুধু ঘাড় মটকে রক্ত খেতেই মজা না, ওদের নরম হাড্ডিগুলোও চিবিয়ে খাওয়া যায়!
কিছুক্ষণ আগেই মটকা একজনের ঘাড় মটকে রক্ত খেয়েছে। ওর চিবুক বেয়ে এখনো তাজা রক্ত ঝরছে! হাতিভূতটা মটকার চিবুক থেকে রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল, ঠিক আছে সোনা, এরপর তোকে দু পেয়ে জন্তুদের একটা দুষ্টু টাইপের ছানাপোনাই এনে দেবো। নে, এখন একটু ঘুমিয়ে নে তো। আমার আবার সকাল সকাল বের হতে হবে।
মায়ের কথা শুনে মটকা বলল, তুমি কি ওটা কাল সকালেই এনে দেবে মা? মটকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বলল, হ্যাঁ, কাল সকালেই এনে দেবো। তবে একটা কথা, আমি সকালে বাইরে বের হলে কিন্তু তুই ভুলেও ঘর থেকে বের হবি না। এ-ঘর ও-ঘর ঘোরাঘুরি না করে চুপচাপ শুয়ে থাকবি। কোথাও কোনো শব্দ হলে গলা বাড়িয়ে দেখতে যাস না যেন। তুই কিন্তু এখনো অনেক ছোট। একবার হারিয়ে গেলে ঘর খুঁজে পাবি না। দু পেয়ে জন্তুগুলোর মধ্যে এক ধরনের জটাধারী বুড়ো লোক আছে। ওরা খুব হাড় বজ্জাত টাইপের হয়। ওদের কারো খপ্পরে পড়লে বিপদও হতে পারে!
মায়ের সামনে মটকা ভীষণ বাধ্য ছেলে। মা যা বলে তাতেই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যায়। কিন্তু মা ঘর থেকে বাইরে বেরোলেই মটকার আসল চেহারা দেখা যায়। ফড়িং ধরা দু পেয়ে দুষ্টু বালকদের মতো এ-ঘর ও-ঘর দৌড়ায় আর কঙ্কাল নিয়ে খেলা করে। খেলতে খেলতে ভালো না লাগলে দরোজার মুখে এসে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। জঙ্গলের কোথায় কে কী করছে চুপচাপ দেখতে থাকে।
এভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে খুব বেশি সময় ভালো লাগে না মটকার। শরীরের মধ্যে কেমন উসখুস করে তার। উপুড় হওয়া থেকে উঠে বসে। ভাবে, একটু যদি জঙ্গলটা ঘুরেটুরে দেখা যেত। গাবদাগোবদা শরীরটা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসে মটকা। মায়ের নিষেধ না মেনে এই প্রথম ঘরের বাইরে পা রাখলো সে। দুই হাত দিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছাতিম গাছের দুই ডাল ধরে কষে একটু দোল খেয়ে নিয়ে থামে মটকা। ডানে-বামে শরীরটা ঘুরিয়ে আচ্ছামতো ঘুরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে বলল, বাহ! আমাদের জঙ্গলটা কী সুন্দর! এদিক ওদিক তাকিয়ে অবাক হয় মটকা। 



একটু দূরেই কয়েকটা ছোট গাছ। মনে হচ্ছে ওরা একজন আরেকজনের গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছোট গাছের মাথায় কয়েকটা চড়–ই পাখি বাসা বানিয়েছে। লতাজাতীয় কোনো গাছের ছোট ছোট শুকনো ডাল, ধানের বিচালি আর খেজুরগাছের পাতা ছিড়ে নিয়ে এসে বানানো বাসাগুলো দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। কয়েকটা বাসায় চড়–ই পাখির ছানাগুলো উপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। ওদের ঠোঁটগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওরা চড়–ই পাখির ছানা নয়, একদল ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষর আকাশের দিয়ে তাকিয়ে ভি… ভি… করে চিৎকার করছে। ওদের চিৎকার শুনে মটকা জানতে চাইলো, কিরে তোরা অমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন?
মটকার কথা শুনে চিৎকার থামিয়ে একটা চড়–ইছানা বলল, চেঁচাচ্ছি কোথায়, আমরা তো গান করছি, মটকা দা। বলেই চড়–ইছানাগুলো আবার এক সাথে গান ধরলোÑ চিঁচি চিঁচি চিঁচিক…
ওদের এমন কোরাস গান গাওয়া দেখে মটকা বলল, তা হঠাৎ করে তোদের গান গাওয়ার কী এমন হলো শুনি?
সবচেয়ে ছোট্ট যে চড়–ইছানা সে বলল, আজ আমাদের অনেক মজার দিন, মটকা দা। অনেক দিন পর আমাদের মামণি পাশের গ্রামে খাবার আনতে গেছে। মজার সব খাবার। ফড়িংছানা, কেঁচো, চালের কণা আরো কতো কী। আমাদের জন্য মজার খাবার আনতে গেছে বলে আমরা এখন মামণির জন্য অপেক্ষা করছি আর গান করছি। চিঁচি চিঁচি চিঁচিক… চিঁচি চিঁচি চিঁচিক…
কোথা থেকে যেন একটা কাঠবিড়ালি লাফাতে লাফাতে এলো। মনে হচ্ছে ওর মুখে কিছু একটা আছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে এক লাফে একটা গাছে উঠে গেল সে। তারপর একটা বড় ডালের ওপর ব্যাঙের মতো পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে খুশিতে লেজ দোলাতে লাগলো। বুঝা গেছে ওর মুখে প্রিয় কোনো খাবার আছে আজ। মুখ থেকে গাছের ডালের ওপর খাবারটা নামালো সে। তারপর সামনের এক পা দিয়ে খাবারটা জুত করে ধরে রেখে সেও একটা গান ধরলোÑক্রি ক্রি ক্রিক… ক্রি ক্রি ক্রিক…
কাঠবিড়ালিটা মটকাদের ঘরের পাশেই একটা আমগাছের খোড়লে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে থাকে। মটকার সাথে প্রায়ই ওর দেখা হয়। মাঝে মধ্যে এক আধটু হাই-হ্যালোও হয়। কাঠবিড়ালির বোতলব্রাশের মতো ফুলো ফুলো লেজটা বেশ ভালো লাগে মটকার। তাই তো আদর করে মটকা কাঠবিড়ালিকে প্রায়ই কাঠু বলে ডাকে। মটকা দা’র মুখে নিজের এই ছোট্ট নামটা কাঠবিড়ালিরও খুব পছন্দ। সেই কাঠবিড়ালি মানে কাঠুর এমন খুশি খুশি ভাব দেখে মটকা ওকে বলল, কিরে কাঠু, খুব যে খুশি খুশি লাগছে। নতুন কিছু পেলি নাকি আজ?
কাঠু তার ফুলো ফুলো লেজটা দুদিকে দোলাতে দোলাতে বলল, পেয়েছি মানে, দারুণ জিনিস পেয়েছি, মটকা দা। রোজ আর ওই কাঁচা পেয়ারা নয়তো বরই খেতে আর ভালো লাগে না। গায়ে একটু সকালের রোদ লাগানোর জন্য আজ জঙ্গলের ওপাশের গ্রামটাতে ঘুরতে গিয়ে একটা বাদাম খুঁজে পেয়েছি, বুঝলে। একেবারে ভাজা বাদাম গো। কী যে মজা করে খাবো। বলেই কাঠু তার সেই মজার গানটা শুরু করলোÑ ক্রি ক্রি ক্রিক…
রোদের তেজ আরো বাড়ছে। মনে হচ্ছে দুপুর হয়ে আসছে। এমন সময় পাশের বাসার চাচা, মামদো ভূতের ছেলে চিচিংদোকে দেখা গেল। চিচিংদো মটকার খুব ভালো বন্ধু। সুযোগ পেলেই মটকাদের বাসায় মাছ নিয়ে আসে। দুই বন্ধু মিলে যা মজা করে মাছ খায়। মটকা মাছের কাঁটা বেছে খেলেও, চিচিংদো ওসবের ধারের কাছেও যায় না। যত বড়ো মাছই হোক চিচিংদো কাঁটাসহ কচকচ করে খেয়ে ফেলে। মাছ খেয়েই ও একটা অদ্ভুত কাজ করে। তেঁতুলগাছ থেকে তিনটা পাতা ছিড়ে নিয়ে পেটের ওপর দুই ডলা মেরে দেয়। এটা করলে নাকি গলায় কোনো কাঁটা আটকে থাকে না!
মটকাদের বাড়ির পাশেই একটা শেওড়াগাছে বাবার সাথে থাকে চিচিংদো। ওর মা একবার জঙ্গলের বাইরে দূরের একটা বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল। মাছ ধরে সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। সেদিন চিচিংদোর মায়ের সাথে দুই শাঁকচুন্নি ভূতও সেই বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল। ওরা কোনোমতে জঙ্গলে ফিরে আসতে পারলেও চিচিংদোর মা আর ফিরে আসতে পারেনি। শাঁকচুন্নিদের কাছে শুনেছে, পাশের গ্রামের জটাধারী এক ভূতের ডাক্তার তাকে ধরে বোতলে বন্দী করে রেখেছে! শাঁকচুন্নিদের কাছে এই ঘটনা শোনার পর থেকে দু পেয়েদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না চিচিংদো। কতদিন মায়ের সাথে দেখা হয় না। মায়ের জন্য তাই সব সময় মন খারাপ থাকে চিচিংদোর।
এহেন চিচিংদোকে মটকার মা হাতিভূত একেবারেই পছন্দ করে না। তার মতে, চিচিংদো হলো একটা বাজে টাইপের ভূত। সমাজে বাস করতে হলে সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। ময়মুরব্বিদের দেখলে সালাম দিতে হয়। তাদের সামনে দিয়ে চলার সময় ভদ্রভাবে চলতে হয়। কথা বলতে হয় নিচুস্বরে। কিন্তু চিচিংদো এসবের কিছুই করে না। সে ভূতসমাজের মুরব্বিদের পাত্তা তো দেয়ই না, সমাজের কোনো নিয়ম-কানুনও মেনে চলে না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে রেগে আগুন হয়ে যায়। যার তার সাথে মারামারি করে বেড়ায়। ওর থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকবি, চিচিংদো।
চিচিংদোকে আসতে দেখে ঘরের দরোজা থেকে একটু ভেতর দিকে সরে এলো মটকা। দরোজা থেকে একটু দূরে উপুড় হয়ে শুয়ে জঙ্গলের এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। চোখ বুজে ঘুমের ভান করে চিচিংদোকে নিয়ে একটু আগে মা যা বলল সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। মা হয়তো কারো কাছে কিছু শুনে চিচিংদো সম্পর্কে ভুল বুঝে আছে। কিন্তু চিচিংদো মোটেও ও রকম নয়। খামোখা সে কারোর সাথে মারামারি তো দূরের কথা, ঝগড়াও করতে যায় না। অকারণে কারো সাথে অন্যায় করা হচ্ছে দেখলে সে বরং রুখে দাঁড়ায়। কেউ বিপদে পড়েছে জানলে তার সাহায্যে এগিয়ে যায়। চিচিংদোর এই গুণটা ভীষণ ভালো লাগে মটকার। ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে বলে মনে মনে গর্বও করে সে।
মটকার মা যে চিচিংদোকে মোটেও পছন্দ করে না সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই তো রাতের বেলা ভুলেও মটকাদের বাসার দিকে যায় না চিচিংদো। সকাল হলে মটকার মা জঙ্গলের বাইরে দু পেয়ে ধরতে যায়। এই সময়টাতেই সে মটকাদের বাসায় আসে। কারণ মটকাকে ভীষণ ভালো লাগে চিচিংদোর। ওর কাছে অনেক কিছু বলা যায়। ও কারো কাছেই সে কথা বলে না। তাছাড়া মটকাটা বাইরের অনেক খবর রাখে। ওর কাছে এলে কতো কিছু যে জানা যায়। এই তো কয়েক মাস আগেই ও বলল, এখান থেকে বেশ দূরের এক মাঠের একেবারে মাঝখানে বিরাট এক বটগাছ আছে। প্রতি মাসের শেষ শনিবার ভরদুপুরে সেই বটগাছে ভূতদের একটা মেলা বসে। অনেক দূর থেকে নানান কিসিমের সব ভূত আসে সেই মেলায়। উফ! কতো যে মজা হয় সেখানে। নাচ-গান, লাঠিখেলা, ভয়দেখানি আরো কতো কী। একবার যাবে নাকি সেই মেলায়? মটকার কথা শুনে আমি তো অবাক। ভূতদের আবার মেলা হয় নাকি!
একবার কী হলো। মটকার মা দু’দিনের জন্য পাশের এক জঙ্গলে বেড়াতে গেল। এই তো সুযোগ। চিচিংদো তো সব সময়ই স্বাধীন। দু’দিনের জন্য এখন মটকাও স্বাধীন হয়ে গেল। কারণ মটকাকে মা সাথে করে নিয়ে যায়নি। মা ঘর থেকে বের হওয়ামাত্রই চিচিংদোর খোঁজে বের হলো মটকা। খুব বেশি সময় খুঁজতে হলো না। একটা ডোবার ধারে ডুমুরগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পানিতে ঢিল ছুড়ছিল। মটকা করলো কী, চুপি চুপি গাছের নিচে এসে চিচিংদোর ঝোলানো পা-টা ধরে নিজেও ঝুলতে লাগলো। এমন কাণ্ড দেখে চিচিংদো বলল, করিস কী, করিস কী। আমি পড়ে যাবো তো, পা-টা ছাড়।
চিচিংদোর পা ছেড়ে দিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলো মটকা। ওর হাসি দেখে চিচিংদো বলল, মা বুঝি বাইরে গেছে, তাই না রে? উপর-নিচে মাথা দুলিয়ে মটকা বলল, দুই দিন বাসায় আসবে না মা! কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার।
গাছের ডাল থেকে এক লাফে নিচে নামলো চিচিংদো। মটকার ঘাড়ে হাত রেখে সে বলল, তাতে কি হয়েছে শুনি?
ঘাড় থেকে চিচিংদোর হাতটা সরিয়ে দিলো মটকা। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বলল, কি হয়েছে মানে? আজ যে মাসের শেষ শনিবার, জানিস না তুই? চল, আজ আমরা বটগাছের সেই ভূতমেলায় যাবো।
হঠাৎ ভূতমেলার কথা মনে পড়ায় চিচিংদো একেবারে লাফিয়ে উঠলো। খুশির চোটে ডিগবাজি খেয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে বলল, আর দেরি কেনরে, এখনি চল।
মটকার সাথে সেদিন সেই ভূতমেলায় গিয়ে সত্যিই অনেক মজা করেছিল চিচিংদো।
খুব বেশিক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারলো না মটকা। ভূত হয়ে কারো ভয়ে এভাবে ঘরে বসে থাকা যায়? গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জঙ্গলের পেছন দিকটার আমগাছের খোড়লে কী আছে আজ তাকে দেখতেই হবে। দুপুরের এই সময়টা চিচিংদোর সাথে একটু খেলতে না পারলে হাত-পায়ে কেমন যেন জ্বালা করে! মাথা ঘুরে বমি বমি ভাব হয়! কাঠুর সাথেও একটু দুষ্টুমি করা দরকার। মজার বাদাম কি শুধু ও একাই খাবে নাকি?
ঠিক করেছে এখন থেকে আর মায়ের সব কথা শুনবে না মটকা। এখন কী আর ও ছোট আছে নাকি? ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে না! ও এখন একাই জঙ্গলের সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারে। চিচিংদোকে সাথে নিয়ে ভূতের মেলায় যেতে পারে। এ-গাছ ও-গাছের ডালে ডালে বাঁদরঝোলা ঝুলতে পারে। পাতায় পাতায় ঘুরে কাঠুর সাথে খেলাও করতে পারে।
একদিনের ঘটনা। ছেলের জন্য দু পেয়ে বাচ্চামানুষ ধরতে খুব ভোরের দিকে ঘর ছাড়লো হাতিভূত। যাওয়ার সময় মটকাকে এটা করো না, ওটা করো না বলে শাসিয়ে গেল। কিন্তু মটকা আজ ওসব শুনলে তো। মা ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই সে বাইরে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই চোখ পড়লো দূরের একটা দেবদারু গাছের দিকে। ওদিকে তাকিয়ে ভাবলো, আকাশছোঁয়া ওই গাছটার মাথায় কী আছে আজ তাকে দেখতেই হবে।
লম্বা পায়ে থপ থপ আওয়াজ তুলে দেবদারু গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো মটকা। চোরাচোখে চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। না, আশপাশে আর কোনো ভূত নেই। শুধু ছোট-বড় অনেক গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো গাছের পাতা সবুজ, কোনো গাছের পাতা হালকা হলুদ। হলুদ পাতাঅলা গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলছে আর র্স র্স সুর করে গান করছে। আর সবুজ পাতাঅলা গাছের কচিপাতাগুলোর ওপর সকালের রোদ নেচে নেচে খেলা করছে। দেবদারু গাছের কাছ থেকে একটু দূরে এসে ছোট গাছগুলোর নিচে দাঁড়ালো মটকা। গাছের নিচে চুপ করে দাঁড়াতেই পাখিদের কিচিরমিচির গান শুনতে পেল সে। কী মিষ্টি গান! সকালে পাখিদের এমন কিচিরমিচির গান শুনে মনটা এক অন্য রকম ভালোলাগায় ভরে গেল তার।
দেবদারুগাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালো মটকা। অনেক লম্বা গাছ। এই গাছগুলো এতো লম্বা হয় কেন? কেউ যাতে ওর ডাল ভাঙতে না পারে সেজন্য? নাকি আকাশের ওপারে গিয়ে কারো সাথে মিতালি করতে চায় বলে সে জন্য? সাড়ে তিনবার মাথা চুলকিয়েও কোনো উত্তর খুঁজে পায় না মটকা। উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে টুকুস করে দেবদারু গাছের মাথায় উঠে যায় সে। এখন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারলো না। এদিকে যাই, ওদিকে যাই করে শেষ পর্যন্ত উত্তর দিকে হাঁটা দিলো। জঙ্গল শেষ হয়ে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। মাঠ দেখে কম করে হলেও তিনবার ডিগবাজি খেলো মটকা। আরে, এদিকটা তো দেখি অনেক সুন্দর! ফসলের মাঠ আছে, মাঠে মাঠে অনেক সবজি চাষ হয়। একটু দূরেই কয়েকটা খরগোশ মিলে গাজর খাচ্ছে। ওদের গাজর খাওয়া দেখে মটকা ভাবলো, জিনিসটা নিশ্চয় অনেক টেস্টি। খেতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু আমার তো গাজর খেতে মানা। মা বলেছে, এই জঙ্গলের কোনো ভূত মাছ ও দু পেয়েদের ঘাড় মটকে রক্ত খাওয়া ছাড়া আর কিছু খায় না।
ভূত হওয়ার আগে জঙ্গল পার হয়ে মাঠের ওদিকে যাওয়া মোটেই নিরাপদ ভাবলো না মটকা। মাঠের দিক থেকে ফিরে জঙ্গল যেদিকে বেশি ঘন ও অন্ধকার মটকা এবার সেদিকে গেল। ভূত বা ভূতের নাতিপুতিরা কোনো কিছু দেখে ভয় পায় না। এমনটা হলে ওদেরকে ভূতসমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু একটা উড়ে এসে পড়ায় মটকা একটু চমকে উঠলো। জিনিসটা কোথা থেকে এসে পড়লো সেটা দেখার জন্য ওপরের দিকে তাকাতেই অবাক হলো মটকা। ওর চমকে ওঠা দেখে কয়েকটা বানর দাঁত বের করে হাসছে। হাসতে হাসতে এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে অন্য গাছে যাচ্ছে। লাফের ফাঁকে ফাঁকে লম্বা লেজ দিয়ে গাছের ডাল পেঁচিয়ে ধরে বাদুড়ঝোলা হয়ে কেউ ফল খাচ্ছে তো কেউ ভেংচি কাটছে। ওদের এমন কাণ্ড দেখে মটকার পিত্তিটা একেবারে জ্বলে গেল!
সামনে এগোতেই আরেকটা খোলা মাঠ চোখে পড়লো। মাঠ ভরা কী সুন্দর সবুজ ঘাস। দু-একটা ঘাসে নানান রঙের ফুল ফুটেছে। মধু সংগ্রহের জন্য কয়েকটা মৌমাছি এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঠের এখানে ওখানে নানান রঙের ফড়িং বাতাসে নেচে নেচে ছোট ছোট পোকা ধরে খাচ্ছে।
মটকা এতদিন মনে করতো তাদের ঘরটাই সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু জঙ্গলের সবখানে এতসব মজার জিনিস আছে দেখে তার মনে হলো এই জঙ্গলটাই সবচেয়ে সুন্দর। মটকা বুঝতে পারছে না, এ সুন্দর একটা জঙ্গল মামণি কেন তাকে ঘুরে দেখতে দেয় না? তার মনে হলো, পুরো জঙ্গল ঘুরে দেখতে পারলে হয়তো আরো অনেক কিছু দেখা যাবে। কিন্তু আজ দুপুর হয়ে আসছে। একটু পরেই মা ঘরে ফিরবে। মটকা তাই ভাবলো, আজ বরং ঘরে ফিরে যাই, কাল আবার আসা যাবে।
এতো সময় ঘোরাঘুরির কারণে সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি মটকার। মামণি কখন আসে তারও কোনো ঠিক নেই। পেটে কিছু দেয়ার জন্য এখন কিছু মাছ পেলে মন্দ হতো না। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো পাশেই একটা ছোট খাল আছে। তালগাছের মতো লম্বা লম্বা ঠ্যাং নিয়ে খালের পানিতে নেমে পড়লো সে। দু-চার বার পানির নিচে হাত চালাতেই একটা শোলমাছ পেয়ে গেল। আর মাছ ধরার চেষ্টা না করে ভাবলো, ছোট ভূতের পেট, এক মাছেই ভরে যাবে। ভূত হলেও মটকা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাম হাতে কুচুরিপানাগুলো এক পাশে সরিয়ে দিতেই টলটলে পানি দেখা গেল। ডান হাতে ধরা মাছটা মানুষের পচাপাট ধোয়ার মতো করে পানিতে কয়েকবার ধুয়ে নিলো। তারপর পেটে চালান করে দিলো।
মাছ খেয়ে উপরে উঠে আসার সময় কেমন যেন একটা শব্দ এলো মটকার কানে। শব্দটা খুব বেশি দূরে হচ্ছে বলে মনে হলো না। আশপাশেই কোথাও হবে হয়তো। কিন্তু শব্দটা কিসের? কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো মটকা। একটু শুনেই বুঝতে পারলো শব্দটা এই জঙ্গলের কোনো প্রাণীর বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এমন শব্দ সে আগে কখনো শোনেনি।
শব্দটা ক্রমেই মটকার কাছাকাছি আসছে বলে মনে হচ্ছে। মর মর, মর মর। বেশ মিষ্টি শব্দ তো! এমন চমৎকার শব্দ তুলে কোনো প্রাণী এই জঙ্গলে চলতে পারে! মটকা ভীষণ অবাক হলো। মায়ের কথা শুনে সব সময় ঘরে বসে থাকায় জঙ্গলের কোনো কিছুই ভালো করে জানা হয়নি দেখে নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হলো মটকার। সে আর বোকা থাকতে চায় না। এখন থেকে সুযোগ পেলেই জঙ্গলে ঘুরতে বেরোবে। কোথায় কী আছে সব জেনে নেবে।
হঠাৎ করেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। মটকা এটার কোনো কারণ বুঝলো না। তবে এটা বুঝতে পারলো শব্দটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আশপাশের গাছে গাছে থাকা পাখিরা ভয়ে চিৎকার করছে। বানরগুলো এমন চেঁচামেচি করছে। মনে হচ্ছে পুরো জঙ্গলটা ওরা আজ মাথায় তুলে ফেলবে। ওরা সবাই কেন এমন ভয় পাচ্ছে, মটকা কিছুই বুঝতে পারছে না। ওরা কী তাহলে আমার মতো একটা বাচ্চাভূতকে দেখে… ধ্যেৎ, তা হবে কেন? ওদের সাথে তো আমার প্রায়ই দেখা হয়। কই, আগেতো ওদের কেউ এমন চিৎকার-চেঁচামেচি করেনি। ধুর, ওরা যা করার করুক। আমি ঘরে ফিরে যাই।
পেছন ফিরে সামনে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মটকার। পাখি আর বানরদের ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করার কারণটা বুঝতে পারলো সে। একটু দূরেই শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে জটাধারী দু পেয়ে এক জন্তু। এতক্ষণে বুঝা গেল, শুকনো পাতার ওপর এই জন্তুটার পা পড়ার কারণেই মর মর শব্দ শোনা গেছে। দু পেয়ে জন্তুটার পিঠে ইয়া বড়ো একটা ঝোলা। গলায় নানান রকম পুঁতির মালা। গায়ে ছেড়া পাঞ্জাবি। ভীষণ ময়লা। হাতে হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা একটা লাঠি। কোমরে ঝুলছে নানান সাইজের প্লাস্টিকের বোতল। কোনোটা বড়ো, কোনোটা ছোট। দু পেয়ে জন্তুটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। দু পেয়ে জন্তুটা নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু হবে। না হলে, ওটাকে আসতে দেখেই জঙ্গলের পাখি আর বানরগুলো এমন চিৎকার চেঁচামেচি করলো কেন? কী করবে কিছুই ভাবতে পারছে না মটকা। ঝেড়ে দৌড় দেবে? নাকি জন্তুটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে?
দু পেয়ে জন্তুটাকে ভয় দেখানোর কথাই ভাবলো মটকা। জন্তুটা কাছাকাছি আসার আগেই মটকার মাথায় লম্বা দুটো শিং গজিয়ে গেল। ওকে এখন রাগে ফোঁস ফোঁস করা ষাঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। শিংঅলা মাথাটা বাম-ডানে আচ্ছামতো কয়েকবার ঝাঁকালো মটকা। সাথে সাথে ওর চোখ দুটো অনেক বড়ো হয়ে গেল। মুখের ভেতরের দুই পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো তলোয়ারের মতো লম্বা দুটো দাঁত। একটু গা ঝাড়া দিয়ে জলহাতির মতো বিশাল হাঁ করে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকলো মটকা।
দু পেয়ে জন্তুটা মটকাকে দেখে মোটেও ভয় পেল না। হাতে থাকা হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা লাঠিটা আকাশের দিকে উচুঁ করে ধরে বিড় বিড় করে কী যেন বলল দু পেয়ে জন্তুটা। অমনি লাঠি থেকে রঙবেরংয়ের আলোর রেখা বেরিয়ে মটকার গায়ে এসে লাগলো। আলো এসে গায়ে লাগতেই মটকার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। মনে হচ্ছে ওর চারপাশের সবকিছু চরকার মতো ঘুরছে। একটু পরে মটকা নিজেও লাটিমের মতো ঘুরতে লাগলো। এমনটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভয় পেল মটকা। ওর সবকিছু আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে যে! সামনের দিকে তাকালো মটকা। দেখলো, সেই দু পেয়ে জন্তুটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখা একটা বড়ো বোতল বের করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এই সময় গাছের পাখি আর বানরগুলো আরো জোরে চেঁচামেচি শুরু করলো। ওদের এ রকম চেঁচামেচি শুনে মটকা বুঝতে পারলো, ও বড়ো রকমের কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে।
গায়ের সব শক্তি এক করে আকাশ ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলো মটকা। মামণি! মামণি! ও মামণি…! বাঁচাও… কিন্তু এতো জোরে চিৎকার দিলেও ওর গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। আজ কী হলো মটকার। এমন হচ্ছে কেন?
দেখতে দেখতে দু পেয়ে জন্তুটা আরো কাছে চলে এসেছে। পেছন ফিরে ঝেড়ে একটা দৌড় দিতে চাইলো মটকা। কিন্তু পা দুটো মাটি থেকে উঠাতেই পারলো না সে! মনে হচ্ছে কেউ একজন সিমেন্ট-বালু দিয়ে ওর পা দুটো মাটির সাথে চিরদিনের মতো আটকে দিয়েছে! গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই মনে হচ্ছে।
সামনে ঘোর বিপদ। এই ঘোর বিপদে হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়লো মটকার। মা বলে, ছোটরা বিপদ দেখলে ভয় পেয়ে যায়। বিপদ থেকে কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়, তা তারা বুঝতে পারে না। এই জন্য মা-বাবা যখন ঘরে থাকে না তখন ছোটদের কখনোই বাইরে আসা ঠিক নয়।
এখন কোনো কিছু ভাবনা-চিন্তা করার সময় নেই। বাঁচতে হলে যা করার এখনি করতে হবে। তাই করলো মটকা। বাঁচার আশায় শেষবারের মতো ভয়ঙ্কর এক চিৎকার দিলো সে। এমন জোরে চিৎকার দিলো যে আগুন নেভানো গাড়ির চিৎকারও ফেল মেরে গেল! ওর চিৎকার শুনে গাছের ডালে ঘুমিয়ে থাকা একটা বেবুনের বাচ্চা নিচেয় পড়ে গেল। গাছের পাখিরা ভয়ে দূরে উড়ে গেল। পোকা খাওয়া বাদ দিয়ে পালাতে লাগলো ফড়িংয়ের দল।
চিচিংদো।দূরেই একটা গাব গাছের ডাল ধরে আরামসে দোল খাচ্ছিলো। দুনিয়া কাঁপানো এমন চিৎকার শুনে ওরও দোল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পেটের ভেতরে এখনো কেমন কেমন করতে থাকলেও বসে থাকতে পারলো না চিচিংদো। কারণ একটু আগে যে মরণ চিৎকার সে শুনেছে সেই চিৎকারটা কার সেটা তার জানা হয়ে গেছে। জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে তার প্রিয় বন্ধু মটকা নিশ্চয় ভয়ানক কোনো বিপদে পড়েছে। দোল খাওয়া বাদ দিয়ে এক লাফে একটা তেঁতুল গাছের মগডালে উঠে গেল সে। বাতাসের গন্ধ শুঁকে বুঝতে চেষ্টা করলো চিৎকারের শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। তারপর শব্দের উৎস ধরে জঙ্গলের গাছেদের উপর লম্বা লম্বা পা ফেলে আড়াই মিনিটের মধ্যেই মটকার কাছে পৌঁছে গেল চিচিংদো।
মটকার সামনে জটাধারী দু পেয়ে জন্তুটাকে দেখেই ভয়ানক রেগে গেল চিচিংদো। রাগের চোটে বারকয়েক নিজের হাতেই চিমটি কাটলো সে। একটা গাবগাছের মাথা ধরে জোরসে ঝাঁকুনি লাগালো। তাতেও রাগ পুরোপুরি মিটলো না তার। ভালো করে তাকালো জন্তুটার দিকে। পিঠে প্রায় মাটি পর্যন্ত একটা লম্বা ঝোলা ঝুলানো। ডান হাতের মুঠিতে হরিণের শিংয়ের মতো লম্বা লাঠি দেখেই দু পেয়ে জন্তুটাকে চিনতে পারলো চিচিংদো। এই জন্তুটাই হলো সেই দু পেয়ে ভূতের ডাক্তার! বাবার মুখে ওর কথা অনেকবার শুনেছে। চিচিংদো তখন অনেক ছোট। দিনদুপুরে কিংবা ভরসন্ধ্যায় কী করে মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত খেতে হয় সেটা তখনো শেখা হয়ে ওঠেনি। এক আধটু গাছে উঠে ছোটখাটো ডাল ধরে ঝাঁকুনি দিতে পারে এই যা।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাছ খাওয়ার জন্য ভয়ানক কান্না শুরু করলো চিচিংদো। এমন কান্না, মনে হয় ওর বাবা-মা কেউ বাসায় নেই। শুধু কান্না করলে সমস্যা ছিল না। কান্নার সাথে সাথে একবার বাবার হাতে কামড় মারে তো একবার মায়ের হাতে কামড় মারে। এতো কামড় আর কাহাতক সহ্য হয়। শেষে ওর মা বলল, ঠিক আছে, এখনকার মতো এই দুষ্টু বাচ্চাটার মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে নে! তারপর কাল সকালে তোকে মাছ এনে দেবো।
ছেলের বায়না মেটানোর জন্য একদিন খুব সকালবেলা জঙ্গলের বাইরে দূরের এক বিলে চিচিংদোর জন্য মাছ ধরতে গিয়েছিল মা। কী যে দিনকাল হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও একটা বড়ো মাছ ধরতে পারলো না সে। কার কাছে যেন শুনেছে, এখন ফসল চাষে নানান রকম বিষ ব্যবহার করা হয়। এই সব বিষের বেশির ভাগ অংশ বৃষ্টির পানি আর সেচের মাধ্যমে নাকি খাল-বিলে এসে হাজির হয়। বিষ মেশানো এই সব পানি মাছেরা নাকি একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ফলে দিন দিন খাল-বিল থেকে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে! দু পেয়ে জন্তুগুলো যে কতো বোকা সেটা ভেবে খুব হাসি পায় মামদো ভূতের। আরে, তোদের নিজেদের জন্য হলেও তো মাছ রক্ষা করতে হবে।
দু’বারের মাথাতেই কয়েকটা পুঁটি আর ছোট দুটো টাকি পেয়ে গেল। অনেক বেলা হয়েছে। সকাল থেকে চিচিংদোর পেটে কিছুই পড়েনি দেখে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার চেষ্টা করলো। ফিরে আসার সময় একটা বটগাছের ডালে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক এই সময় এই জটাধারী ভূতের ডাক্তারটা বটতলায় একটা গামছা বিছিয়ে তার ওপর বসে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বদ এই দু পেয়েটা গাছের ডালে কিছু একটা বসার শব্দ এবং তাজা মাছের গন্ধ পেয়ে উপরের দিকে তাকাতেই মাকে দেখে ফেলে। ব্যস, আর যায় কোথায়। মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু পেয়ে ডাক্তার জন্তুটা তাকে বোতলবন্দী করে ফেলল!
সেদিন অন্যায়ভাবে মাকে বোতলবন্দী করায় দু পেয়ে ডাক্তার জন্তুটাকে সামনা সামনি পেয়ে মাথার চান্দি গরম হতে লাগলো চিচিংদোর। চান্দিটা ফটাস করে ফুটে যায় কি-না সেই চিন্তায় লম্বা হাত দুটো বাড়িয়ে পাশের এক মরা পুকুর থেকে কয়েক খাবলা পানি এনে মাথা ভেজাতে লাগলো! মাথায় পানির ছিটা দেয়ায় ঝামেলা আরো বাড়লো। রাগের চোটে ওর পেট ফুলতে লাগলো। দুই চোখ থেকে হয়ে গেল তিন চোখ! চোখগুলো এমন বড় আর লাল হতে লাগলো যে, মনে হলো সব চোখ থেকে এখনি আগুনের গোলা বের হয়ে আসবে! চিচিংদোর হাত-পাগুলোও লম্বা হতে লাগলো। লম্বা হতে হতে এক সময় তালগাছ ছাড়িয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলল।
সামনে হঠাৎ চিচিংদোকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মটকা। প্রিয় বন্ধুকে সামনে পেয়ে আনন্দে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল মটকা। ওর এমন কান্না দেখে চিচিংদো বলল, শাঁকচুন্নিদের মতো এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিসনে তো মটকা। জঙ্গলবাড়ির কোনো ভূত কিংবা ভূতের পুত কখনোই কাঁদে না। চিচিংদো রাগে পেট ফোলাতে ফোলাতে বলল, দু পেয়ে বদমাস, তোর কতো বড়ো সাহস। লাঠি, ঝোলা আর বোতল সাথে নিয়ে আজ একেবারে আমাদের জঙ্গলেই ঢুকে পড়েছিস? আজ তোর ডাক্তারিটা ভালো করেই শেখাবো, দাঁড়া। এমন শিক্ষা দেবো যে…
দু পেয়ে জন্তুটা সেই তখন থেকে চিচিংদোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ফাঁকে একটু বাঁক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মটকা। এখন আর ভয় করছে না তার। মটকাকে বোতলবন্দী করার জন্য জটাধারী বুড়ো যে বোতলটা বের করেছিল, সেটা আবার কোমরে ঝোলাতে গেল। মাথা নিচের দিকে থাকায় চিচিংদো কিংবা মটকা কারোর দিকেই বুড়োর এই সময় নজর ছিল না। সুযোগটা ভালোমতোই কাজে লাগালো চিচিংদো। জটাধারী বুড়োর হাত থেকে এক টান দিয়ে হরিণের শিংয়ের মতো বাঁকা সেই লাঠিটা কেড়ে নিলো। তারপর লম্বা দুই হাত দিয়ে লাঠিটা মাঝখান থেকে মটাস করে ভেঙে ফেলল।
অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটলো। হঠাৎ ছোট হয়ে যাওয়া মটকা আবার বড়ো হয়ে গেল! বুঝতে পারলো, বুড়োর লাঠিটা ভেঙে ফেলার পরই এমনটা হয়েছে। তার মানে জটাধারী বুড়ো শয়তানের ওই লাঠির মধ্যে কোনো জাদুটাদু ছিল! সেটার জোরেই বুড়ো মটকাকে ছোট করে ফেলেছিল। লাঠিটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে ভালোই করেছে চিচিংদো।
লাঠিটা হারিয়ে ভূতের ডাক্তার নামধারী বুড়ো জটাধারী কেমন যেন করতে লাগলো। পিঠে ঝুলানো লম্বা ঝোলার মধ্যে গরুর কয়েকটা শিং থাকলেও সেগুলো বের করার কোনো সুযোগই পেল না বুড়ো। কারণ তার সামনে এখন জঙ্গলবাড়ির দুই বিশালদেহী ভূত দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠা মটকা বুড়ো জটাধারীর পিঠের ঝোলাটা একটানে কেড়ে নিলো। দূরে কোথাও ফেলে দেয়ার আগেই মটকার হাত থেকে এক থাবায় সেটা কেড়ে নিলো চিচিংদো। বিশাল এক হাঁ করে পুরো ঝোলাটা সেই হাঁ করা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো সে। পেটের ওপর হাত বুলাতেই ঝোলাটা হজম!
ঝোলা হারিয়ে বুড়ো জটাধারী একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। কোমরে ঝুলিয়ে রাখা বোতলগুলো একের পর এক জঙ্গলবাড়ির সেই পুরনো পুকুরে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। কারণটা বুঝতে পেরেই চিচিংদো বুড়ো জটাধারীর গলা ধরে উঁচু করে ফেলল। দু পেয়ে জন্তুগুলো একদিন মটকার মাকে যেভাবে পিটিয়েছিল, পেটানোর পর শুঁড় ধরে একটা গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলেছিল, চিচিংদোও তাই করলো। বুড়ো জটাধারীর কোমর থেকে বোতল খুলে নিয়ে আচ্ছামতো বোতলথেরাপি দেয়া শুরু করলো। তারপর দুই হাত ধরে একটা গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে শিড়দাঁড়াটা মট করে ভেঙে দিলো বুড়োর।
সব বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলে দিতে লাগলো চিচিংদো। যে আশায় সে বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলছে সেটা পূরণ হচ্ছে না দেখে হতাশায় মুখটা কালো হতে লাগলো তার। আকাশ কাঁপানো এক চিৎকার দিয়ে বাকি বোতলগুলো একটা গাছের গুঁড়ির ওপর সজোরে আছাড় মারলো চিচিংদো। আর ঠিক তখনি একটা ভাঙা বোতলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক বুড়ি। এতো বছর পরে মাকে চিনতে একটুও ভুল হলো না চিচিংদোর। এই বুড়িটা আর কেউ নয়, তার প্রিয় মা, মামদো ভূত। মা-ছেলে অনেকক্ষণ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। তারপর মায়ের বুক থেকে মুখ সরিয়ে মটকার দিকে তাকাতেই দেখলো, দূরে দাঁড়িয়ে হাতিভূতটা পাতালি দিচ্ছে!

ভূকা ২৩ : নিশির ডাক

আমাদের গ্রামের বাড়িতে কোন একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে একবার অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলো। অনুষ্ঠানটি হয় রাতর বেলা। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়, ফলে যাদের বাড়ি দূরে তারা সবাই ঠিক করে যে আজ এখানেই থাকবে। মামার বাড়িতে মোট ৫ টা ঘর আর একটা বাংলো ঘর। বাংলো ঘরটা তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না। বাংলো ঘরের ডান পাশে কিছুটা দূরে গোয়াল ঘর। যেহেতু, অনেকেই রাতে থাকবে, তাই ঘরের অভাব শর্ট পড়ে গেলো। তাই মামামামি সিদ্ধান্ত নিলো তারা তাদের ঘরটা ছেড়ে বাংলো ঘরে চলে যাবে। রাতটা সেখানেই কাটাবে।


তখন রাত প্রায় ২টা। মামার টয়লেট চাপায় তিনি জেগে উঠেন। উনি দরজা খুলে বাইরে উঠোনে একটু দূরেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি একটা শব্দ শুনতে পান। তিনি এদিক ওদিক তাকান। হটাৎ তার দৃষ্টি যায় গোয়াল ঘরের দিকে। তিনি দেখতে পান গোয়াল ঘর থেকে তাদের সাদা রঙের গরুটা কিভাবে যেনও বের হয়ে পড়েছে। মামার তখন মনে পড়ে গোয়াল ঘর সন্ধার পর সবসময় তালা লাগানো থাকে। গরুটা বের হয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে দেয়। গোয়াল ঘরের ঠিক পিছনেই একটা বড় আকারের ঝোপ। অনেকটা জঙ্গলের মত। মামা গরুটার পিছু নিলেন।


এদিকে মামার দেরি দেখে মামিরও ঘুম ছুটে যায়। তিনি বাইরে এসে দাঁড়ান এবং দেখতে পান মামা হাঁটছেন আর তার সামনে একটা সাদা কিছু। মামি ভয় পেয়ে চিৎকার করে মামাকে ডাক দেন। কিন্তু মামা মামির ডাক শুনতে পেয়েও না থেমে উল্টো হাঁটতে থাকেন। মামি ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে মামাকে থামান। মামা তখন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। তিনি বার বার বলতে থাকেন, “আমাদের গরুটা চলে যাচ্ছে। আমাদের গরুটা চলে যাচ্ছে।” কিন্তু মামি বলেন ঐটা আমাদের গরু না, তারপর তাকে জোর করে ঘরে নিয়ে আসেন। সকালে মামামামি ২জনই গোয়াল ঘোরের তালা পরীক্ষা করে দেখেন তালা দেয়াই আছে। আর সবকটা গরুই ঠিকঠাক মতন নিজ নিজ জায়গায় আছে। মামি তখন মামাকে বলেন, গতকাল রাতে তাকে “নিশা” ডাকছিল। মামি যদি তখন না উঠতেন ঘুম থেকে আর মামাকে না থামাতেন, তাহলে গরু রূপি “নিশা” মামাকে বনের ভেতর নিয়ে মেরে মাটিতে গলা অব্দি পুঁতে রাখতো।


ভূকা ২২ : সর্বভুক জিন রাজু

নাম তার জিন রাজু। নামের মধ্যেই যেন চমক। সে কি খায়? তা জানার আগে জানতে হবে সে কি না খায়। জিন রাজু খায় কীটনাশক বাসুডিন, জ্যান্ত সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকিসহ আরো কতো কি। দু'তিন কেজি ইউরিয়া সারও তার স্বাভাবিক খাবার। কখনো ফাঁসির দড়ি গলায় লাগিয়ে ঝুঁলে পড়ে গাছের ডালে!

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার পাছপাড়া গ্রামের আব্দুর রহিম সরকারের ছেলে রাজু। ৭ ভাই ২ বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ছোট বেলা থেকে দুর্দান্ত সাহসী ছেলে রাজু। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। বতর্মান বয়স ৩৫। প্রথম খায় বিষ: ক্লাস থ্রিতে তখন পড়ে রাজু। বয়স ১০ কি ১১ হবে। নিজেদের ফসলি ক্ষেতে পোকামাকড় দমনের জন্য এক বোতল কীটনাশক আনে বাবা। সেই কীটনাশক বোতল হাতে নিয়ে ভাবনায় মসগুল রাজু। এই বিষ খেয়ে পোকা মাকড় মরে। কিন্তু আমি খেলাম অথচ মরলাম না_এমন যদি কিছু একটা হয়ে যায়। নিশ্চয়ই চারদিক জানাজানি হবে। নাম খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। এমনই এক ভাবনা থেকে তার শুরু। প্রথমে মাথার চুল কীটনাশক বোতলে ডুবিয়ে চুল চুষে চুষে খায়। এতে বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে। ২/১ দিন বন্ধ থাকার পর আবার শুরু। প্রতিদিন একবার। তারপর দুইবার চুষে খায়। ক্রমেই সহ্য এসে যায় তার। এক পর্যায়ে চুল বাদ দিয়ে সুতার আগা কীটনাশকে ভিজিয়ে খেতে শুরু করে। এরপর ড্রপারের সাহায্যে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বতর্মানে সে বোতল দিয়েই কীটনাশক খেয়ে রীতিমতো সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। খাদ্য তালিকায় আর যা আছে: সাপ, তেলাপোকা, টিকটিকি, ইঁদুর, ব্যাঙ, গুঁইসাপ, বিড়াল, কুকুর, শিয়াল সবই তার খাবার। এক কথায় সর্বভুক রাজু। তবে তার শর্ত দুটি। এগুলো জীবিত এবং দেশি হতে হবে।

অনেক জায়গায় উণ্ডুক্ত মঞ্চে বিচিত্র এসব খাবার খেয়ে বিপুলসংখ্যক দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে সে। ফাঁসিতে ঝোলা তার সর্বশেষ চমক: সাধনা তার চলছে। গলায় ফাঁস লাগানো দড়ি গাছে ঝুলিয়ে থাকেও সে কিছুক্ষণ। বিপজ্জনক কর্মে তার সাধনা চলছে দীর্ঘ এক যুগ ধরে। এ বিষয়টি নিয়ে তার উণ্ডুক্ত চ্যালেঞ্জ যুক্তিযুক্ত নাও হতে পারে ভেবে এখন পর্যন্ত কেউ গ্রহণ করেনি। ফলে সে নিজেকে অপ্রতিদ্বদ্বী মনে করে। কেমন করে জিন রাজু হয়ে ওঠা: অলৌলিক কিছু 'জিন' দ্বারাই সম্ভব বলে নিজ থেকে রাজু নামের সঙ্গে জিন শব্দটি যুক্ত করেছে বলে সে জানায়।

তার কর্মকাণ্ডও জিনের মতো অলৌকিক বলে মানুষও এ নামে ডাকে। এছাড়া, জিন রাজু ডাকটি তার নাকি খুব ভালো লাগে। এলাকায় একটি কথা লোকমুখে আছে, ছোট শিশু বাচ্চারা দুষ্টমি করলে কিংবা না ঘুমাতে চাইলে মায়েরা জিন রাজুর কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যায়। ফ্রি চিকিৎসায় ছুটে চলা: সাপে কাটা কোনো রোগীর খবর পেলেই হলো। এক আজব আকর্ষণে ছুটে যেতে হয় তাকে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় বলে কথা নেই। ফ্রি চিকিৎসা তার গুরুর আদেশ। সামান্য পানিও পান করা যায় না রোগীর বাড়ি। এছাড়া, বাচ্চাদের বাতাস লাগা, রাতে বিছানায় প্রসাব করা, জিনে ধরা ইত্যাদি রোগেও চিকিৎসা করে সে। রাজুর নিজের কথা একদিনে এসব সাধন হয়নি। অনেক ধৈর্য, নীরব সাধনা করতে হয়েছে। ভারতের কামরূপ কামাখ্যায় থাকতে হয়েছে বেশ ক'বছর। ভাত, রুটির বদলে খেতে হয়েছে গাছের পাতা, বাকল। এক উপজাতি গুরুর শিষ্যত্ব পেয়ে ধন্য হয় জীবন।

তার বক্তব্য আমাদের দেশের বড় সমস্যা দারিদ্র্য। আমি এমন কিছু খাবার খেতে চাই যা খেয়ে দীর্ঘদিন না খেয়েও সুস্থ থাকা যায়। অনেক স্বপ্নই পারিবারিক দুরবস্থার জন্য সম্ভব হয় না। চর্চা চালাতেও হোঁচট খেতে হয় অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে। আমি যা খাই, হজম করি তা তিলে তিলে সাধনার ফল। আমার মতো শখ করে কেই যেন সর্বভুক না হয়। তাহলে কিডনি যাবে, পাকস্থলি যাবে, এমনকি যাবে স্বাদের এ জীবনটাই। রাজুর ইচ্ছে: অনেক দিনের সাধনা তার খ্যাতির জন্য। খ্যাতির জন্য মানুষ কি না করে। তার ইচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তার আজব খাবার-দাবারের দৃশ্য দেশবাসীকে দেখানো। প্রয়োজনে মিনিট দুয়েকের জন্য ফাঁসিতে ঝোলাও।

হানিফ সংকেতের ইত্যাদি তার প্রথম টার্গেট।

ইতমধ্যে স্যাটেলাইট একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রস্তাব পেলেও সে রাজি হয়নি। তার চাই বাংলাদেশ টেলিভিশন_এটি শহর-গ্রাম জনপদের সর্বসাধারণ দেখে। এমন সুযোগ পেলে তার স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে, সার্থক হবে পরিশ্রম।


ভূকা ২১ : ভেন্টিলেটর দিয়ে জিন প্রবেশ করছে

সিলেট নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই রোডের দিগন্ত-২৭ হাজী ভিলার নিচতলা। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুরু হয় জিকির আসকার। চলে রাতভর। গতকাল ভোর হতেই বাসার ভেতর থেকে ভেসে আসে জিকিরের সঙ্গে শোর-চিৎকার। এগিয়ে যান প্রতিবেশীরা। দরজায় কড়া নাড়েন, তবে খুলে দেয়নি কেউ। বাসার একটি রুমের জানালা দিয়ে পুলিশ ডাকতে বলেন ওই বাসার ভাড়াটে সপু চৌধুরী। সকাল সাড়ে ৭টায় পুলিশ এলে দরজা খোলেন বাসার মহিলারা। বাসার একটি রুম থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় স্কলার্সহোম কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করা মেধাবী ছাত্রী সৈয়দা মারওয়া রিফাতকে। প্রথমে তাকে নগরীর একটি ক্লিনিক ও পরে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রিফাতের ছোট ভাই সৈয়দ মারওয়ান রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার মা অনেক দিন থেকে মানসিক রোগে ভুগছেন। বাসায় জিন-ভূতের আগমন ঘটেছে বলে রাতে তিনি প্রায়ই চিৎকার করতেন। এক সপ্তাহ আগে তার মামা ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী দুবাই থেকে আসেন। দু'দিন পর থেকে মামার মধ্যেও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। বাসার কাজের বুয়া রুকিনার পরামর্শে তার মা দারস্থ হন রায়নগর দর্জিবন্দের কথিত পীর মা তফুরা বেগমের। 'পীর মা' সবকিছু শুনে বলেন, তাদের বাসায় জিন-ভূত 'আছর' করেছে। গত বুধবার থেকে তিনি জিন-ভূত তাড়ানোর চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসার জন্য একটি গরু ও এক ভরি স্বর্ণ দাবি করেন 'পীর মা'। তার চাহিদা অনুযায়ী গরু ও স্বর্ণের মূল্য বাবদ ৭৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয় বুধবার। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় পরিবারের সবাইকে পীর মায়ের কাছে নিয়ে যায় কাজের বুয়া। পীর মা তাদের 'ফুল ভেজা পানি' খেতে দেন। সঙ্গে দিয়ে দেন কয়েকটি তাবিজ এবং আরও কিছু পানি ও তেল পড়া। নির্দেশ দেন রাতভর জিকির আসকার করতে।

মারওয়ান জানায়, রাতের খাবার খেয়ে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। শুধু তার মা বাসার উত্তর পাশের রুমে উচ্চৈঃস্বরে জিকির করতে থাকেন। রাত ২টার দিকে তিনি সবাইকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বলেন, ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে জিন-ভূত প্রবেশ করছে। তিনি সবাইকে নিয়ে ওই রুমে জড়ো হয়ে জিকির শুরু করেন। কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দেন ঘরের সবক'টি ভেনটিলেটর। মুঠোফোনে পীর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরামর্শ নেন। রুমের ভেতর কাগজ ও কাপড় পুড়িয়ে সবাইকে মুখের ভেতর ধোঁয়া নিতে বলেন। পীর মায়ের দেওয়া বিকট গন্ধযুক্ত পানি খেতে দেন সবাইকে। এরপর আবারও পীর মায়ের পরামর্শ নেন মুঠোফোনে। পীর মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী বাসার সবাইকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করেন। মেয়ে রিফাত ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে রাজি না হওয়ায় 'পীর মায়ের' পরামর্শে-নির্দেশে রিফাতকে বাথরুমে ঢুকিয়ে কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে বালতির পানিতে মাথা চুবাতে থাকেন মা সিদ্দিকা চৌধুরী ও মামা ইশতিয়াক চৌধুরী। এক সময় রিফাত অচেতন হয়ে পড়ে। থানা হাজতে আটক কাজের বুয়া রুকিনা বেগম জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে পীর মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী সারা রাত জিকির করা হয়। এ সময় গৃহকর্ত্রী সিদ্দিকা চৌধুরী ও তার ভাই ইশতিয়াক চৌধুরী পরিবারের লোকজনকে মারধর করেন। 'পীর মা' তফুরার ছেলে থানাহাজতে আটক ইসলাম উদ্দিন জানান, সাত বছর বয়স থেকেই তার মা 'পীরাকি' পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সারারাত তার মা জায়নামাজে বসে রিফাতের পরিবারের জন্য দোয়া করেছেন এবং মুঠোফোনে সিদ্দিকা চৌধুরীকে পরামর্শ দিয়েছেন। সিলেট কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক নারায়ণ দত্ত জানান, কথিত 'পীর মা'কে আটক করতে তার আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কথিত পীরের বোন, ছেলে, ছেলের বৌ ও নিহতের বাসার কাজের মেয়েকে আনা হয়েছে।

ঢাকা, শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০১০, বাংলাদেশ প্রতিদিন


ভূকা ২০ : কালীসাধিকার বান

আমার বাবা একজন সরকারী চাকরীজীবি ছিলেন। উনি জীবনে কখনই ভুত প্রেতে বিশ্বাস করতেন না- কিন্তু ভগবানকে খুবই বিশ্বাস করতেন। আমাদের গ্রামে আমার ঠাকুরদাদা ও বাবার বেশ সুনাম ছিলো এবং আছে। কিন্তু আমার বাবার শত্রুও ছিলো। আমার ঘরেরই শত্রু- আমার ছোট ঠাকুরমা। উনি আমার দাদুর ছোট ভাই এর বৌ ছিলেন এবং উনি কারো উন্নতি সহ্য করেন  না। কেউ উন্নতি করতে গেলেই উনি বাঁধা দিতেন-পরোক্ষ ভাবে।

আমার বাবা যখন আমাদের গ্রামেই ২ কাঠা জমি কিনেন বাবাদের চার ভাই মিলে তখন ঐ মহিলা আমার বাবাকে বাঁধা দেন মৌখিক ভাবে; বলেন উনার স্বামী-আমার ছোট দাদু মারা গেছেন নতুন জমি কিনে ওখানে পুকুর খুরতে গিয়ে। আমার বাবাও ঐ নতুন জমিতে পুকুর খোড়ার পরিকল্পনা করছিলেন। বাবা জানতেন ঐ মহিলার কান্ড কারখানা, তাই কিছু না বলে পুকুর খোঁড়ান, তারপর পুকুরপাড়ে গাছ লাগান অনেক।

এর ১ বছর পর বাবার হার্ট এর প্রবলেম শুরু হয়। বাবা কাউকে বলতেন না উনার অসুখের কথা-শুধু মা জানত। মা ডাক্তার দেখান বাবাকে। আমি তখন ঢাকায়। বাবাকে ডাক্তার অনেক চেকআপ করান - অসুখ শুধু পেলেন হার্ট এর একটা ভেইন পুরু হয়ে গেছে চর্বি জমে। এটা খুব সাধারণ অসুখ তাই ডাক্তার নরমাল হার্ট এর ঔষধ দিলেন।

এভাবে কিছু দিন চলল। আমি তখন ঢাকা-বাবার অসুখ বেড়ে গেল। ডাক্তাররা কোন রোগ ধরতে পারছিলেন না। এমন সময় মার মনে সন্দেহ হয়-উনি এক কালীসাধিকার কাছে যান। কালীসাধিকা বলেন বাবাকে বান মারা হয়েছে; মরণ বান। বাবার হাতে ১০ দিন বাকি আছে -১০দিনের মাঝে বান কাটা না হলে বাবা মারা যাবেন। কে মেরেছে জিজ্বাসা করতেই ঐ মহিলার নাম বলেন কালীসাধিকা - যদিও কোন দিনই উনারা পরিচিত ছিলেন না।

মা বান কাটান ১০০০ টাকা খরচ করিয়ে। বান কাটানোর পরে বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন অনেকটা। দিন তিনেক না যেতেই বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা আবার যান ঐ কালীসাধিকার কাছে-কালীসাধিকা আবার বান কাটেন-এবার নাকি ৭ দিনের মাঝে মারা যাওয়ার জন্য বান মেরেছিলেন।


এরপর বাবা আবার সুস্থ হলেন। এর মাঝে ঐ মহিলা বাবাকে দেখতে আসেন। বাবাকে দেখতে আসার ছলে বাবাকে আবার বান মারেন উনি। বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবার খুবই খারাপ অবস্থা হল বাবার। হাসপাতালে ভর্তি করা হল বাবাকে। আমার কাকারা মার একটা কথাও বিশ্বাস করতেন না। তাই উনারা ডাক্তার এর কথার উপর ভরসা করেন।ডাক্তাররা বাবার হার্ট ব্লক ছাড়া কোন রোগই ধরতে পারছিলেন না।

এমন সময় মা আবার ঐ কালীসাধিকার কাছে লোক পাঠালেন -আর নিজে বসে থাকলেন বাবার পাশে - কালীসাধিকা আবার বান কাটলেন-এবার একটা আস্ত ডাবের ভেতর থেকে গল গল করে রক্ত বের হয় - এ সময় আমার বাবার মুখ দিয়েও বেশ রক্ত ঝড়ে। এর আগে বাবা বিছানায় বেশ ছটফট করছিলেন - বান কাটার পর তিনি বেশ সুস্থ হন। ডাক্তার বিকেল বেলা ছেড়ে দেবেন জানান। আমি ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম-ডাক্তারের কথা শুনে আমিও বাসায় চলে আসি। বাবার পাশে শুধুই মা ছিলেন।
 এর এক ঘন্টা পরেই বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি যে ঐ মহিলা এক ঘন্টার বান মেরে বাবাকে মেরে ফেলতে পারেন।

বাবা এক সময় মারা যান। আমি শুনে স্থম্ভিত হয়ে পড়ি।

এরপর বাবাকে অনেকেই দেখেছে আমাদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তায়। কেউ কেউ বাবার কান্না ও শুনেছে-কিন্তু যে আমি চাই বাবাকে খুব কাছে পেতে সেই আমার কাছে বাবা কখনোই দেখা দেননি। হয়তো আমি ভয় পাবো বলে। তবে এখনও কোন বিপদ হলেই তার আগে বাবাকে স্বপ্নে দেখি। দেখি বাবা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার মাথায় - ঠিক যেমনটা আমাকে দিতেন ৫ বছর আগে।


পাঠিয়েছেন:
nosto kobi


ভূকা ১৯ : চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ‘বান নিক্ষেপ’

ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী সৈয়দ কওছর আহমদ হঠাৎ করে রহস্যজনক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবে এলাকায় গুঞ্জন উঠেছে, প্রতিহিংসা বশতঃ তাকে ‘বান নিক্ষেপ’ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে চেয়ারম্যানের বাড়ীতে গিয়ে উঠান জুড়ে প্রায় শখানেক মাওলানাকে খতম পড়তে দেখা যায়।

জানা যায়, গত সোমবার দুপুরে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে সৈয়দ কওছর আহমদকে মোবাইলে জানানো হয় তাকে প্রাণে মারার জন্য সুনামগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জের দুজন কবিরাজ দিয়ে তাবিজ কবজ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু কওছর আহমদ মোবাইলের বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে নির্বাচনী গণসংযোগ চালিয়ে যান। বিকাল ৫টার দিকে দক্ষিণ গোয়ালাবাজারে তিনি অসুস্থ বোধ করলে তাকে স্থানীয় ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার তার রোগ ধরতে না পেরে তাকে বিশ্রামের নির্দেশ দেন।

রাত ১১টার দিকে সৈয়দ কওছর আহমদ তার বাড়ীতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙ্গলে তিনি তার সারা শরীরে অবচেতন বোধ করেন। তার মুখ ও জিহ্বা বাঁকা হয়ে যায়। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। সাথে সাথে ডাক্তার নিয়ে যাওয়া হলেও ডাক্তাররা এ রোগ তাদের দিয়ে সারানো সম্ভব নয় বলে জানান। পরবর্তীতে তাকে সিলেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হলে এ সময় চেয়ারম্যানের অসুস্থ্যতার খবরে তাকে দেখতে আসেন পারিবারিক আত্মিয় পইলভাগের মাওলানা মনোয়ার আহমদ।


তিনি কপালে হাত দিয়ে সৈয়দ কওছর আহমদকে পর পর ৩টি বান (!) মারা হয়েছে বলে জানান। মাওলানা মনোয়ার আহমদ কিছুক্ষণ ঝাড়-ফু দিলে সৈয়দ কওছর আহমদের শরীরে চেতন ফিরে আসে এবং তিনি কথা বলতে শুরু করেন। কওছর আহমদকে বান মারা হয়েছে এমন খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন তাকে একনজর দেখতে ভিড় জমায়।

অসুস্থ সৈয়দ কওছর আহমদ বলেন, আমি জানি না সত্যি সত্যি আমাকে বান মারা হয়েছে কি না। তবে যদি কেউ এ কাজ করে থাকেন তবে তা মানবতা বিরোধী বলেই ধরে নিতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা থাকবে। বিরোধীতার খাতিরেই বিরোধীতা করতে হয়। কিন্তু কেউ কারো প্রাণ সংহার করবে-এমনটা কখনোই কাম্য নয়। আমি এ বিচারের ভার মহান আল্লাহ এবং এলাকার জনগণের উপর ছেড়ে দিলাম।

দৈনিক উত্তর-পূর্ব
২২ জুন ২০১১


ভূকা ১৮ : সময় তখন রাত ২.৫৯

আতিক, মোতাহের, সাবু, আর মাহবুব। চার বন্ধু । প্রানের বন্ধু বলতে যাকে বোঝায়। স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি অবধি সবাই একসাথে। একজন আরেকজনের জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, পাওয়া–না পাওয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন তারা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, তখন কত মজা করেই না দিনরাত এক করে আড্ডা দিতো। টি, এস, সি, রমনা পার্ক, কার্জন হল ধাপিয়ে বেড়াতো চারবন্ধু মিলে। কিন্তু সুখপাখি কখনো চিরদিনের জন্য খাঁচায় বন্দি থাকতে চায় না। ছাড়তে তাকে হবেই। ভার্সিটি পাশের পর একেকজন চলে গেলো একেক দিকে। মোতাহেরর চাকরি হল টেলিকম কোম্পানিতে, মাহবুবের হল ব্যাংকে। সাবু চলে গেলো ঢাকা ছেড়ে টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে। এখন তাদের মাঝে আর দেখা সাক্ষাত হয় না তেমন একটা।

এইবার ঈদের ছুটিতে সব বন্ধু একত্র হবার প্ল্যান করলো তারা। পরিকল্পনাকারী মূলত মোতাহের। পাশ করার পর গ্রামীনফোনে চাকরি করছে। খোলামেলা জীবনটা হঠাৎ করে যেনও খুব বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। যেইসব বন্ধুদের ছাড়া আগে একটি দিন কাটানো মুশকিল হয়ে যেত, আজ তাদের সাথে ফোনে কালেভদ্রে কথা হয়। আর দেখা প্রায় হয় না বললেই চলে। পরিকল্পনার কথা খুলে বলল সবাইকে। ঈদের তৃতীয়দিন টি, এস, সি তে চার বন্ধু দেখা করবে ঠিক হল।

যথাসময়ে জায়গামত পৌঁছে গেলো তিনজন। শুধু আতিকের দেখা নেই। সাবু জানালো, আতিকের সাথে কথা হয়েছে তার। আতিক নাকি অফিসিয়াল কি একটা কাজে ঈদের পরদিনই পঞ্চগড় ফিরে গেছে। আজকে সকালে ঢাকায় এসে তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা। কিন্তু কথা রাখেনি সে। হয়তো অফিসিয়াল কাজটা বেশি জরুরি ছিল, হয়তো শেষ মুহূর্তে আটকে গেছে। পরস্পরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তারা। কিন্তু আতিকের একেবারেই যোগাযোগ না করার ব্যাপারটা কেমন কেমন যেনও ঠেকল সবার কাছেই। তবে কি শুধু সময়ের প্রয়োজনেই বন্ধুত্ব?? আজ সবার জীবন আলাদা পথে ধাবমান। কে কার জন্য কোথায় বসে আছে তা দেখার সময় কই??

 ভুলটা ভাঙল পরেরদিনের খবরের কাগজ পড়ে। খবরের কাগজে ছোট করে একটা খবর দেয়াঃ 

বেপরোয়া গাড়ি চালানোঃ

বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে পঞ্চগড়ে রুটে ৫জন নিহত।

ব্যাপারটা সর্বপ্রথম লক্ষ্য করে মোতাহের। বাকিদের সাথে সাথে জানায়। হতদন্ত হয়ে ছুটে আতিকের বাসায়। যেখানে ঈদের খুশিকে ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে গুঞ্জন তুলে বেড়াচ্ছিল আতিকের আত্মীয় স্বজনের আহাজারি।
যান্ত্রিক জীবনে বেঁচে থাকা এবং নিজেকে মানিয়ে নেয়ার তাড়নায় আবার নতুন করে জীবন শুরু করে তিনবন্ধু। সেই জীবনে নেই তাদের একজন প্রিয় মানুষ। যার জন্য তারা অপেক্ষা করে ছিল। একবারের জন্যও শেষ দেখাটা হল না।


প্রায় ৪-৫ মাস পরের ঘটনা।
 মাহবুব বিয়ে করেছে ২ বছর হল। ভার্সিটিতে পরিচয়, সেই সূত্রেই বিয়ে। বাবা–মা বিয়ে মেনে নেয়নি দেখে আলাদা বাসা নিয়ে থাকে জামাই বউ।

মঙ্গলবার রাত ১২টার পরের ঘটনা।
 ঘুমাচ্ছিল মাহবুব। পাশেই তার বউ আসমা শোওয়া। হটাত মাহবুব অনুভব করলো তার বিছানার পাশে বসে কে যেনও আলতো করে হাত রাখল তার গায়ে। আসমার হাত মনে করে প্রথমে পাত্তা দিল না সে। কিন্তু পরের কণ্ঠস্বরটা শুনে ঘুম ছুটে গেলো তার। এই কণ্ঠস্বর যে তার চিরচেনা!! এ তো আতিকের কণ্ঠ! আস্তে আস্তে তাকে ডাকছে, “হুউঁ, কিরে গাধা! এখনও আগের মতই আছিস? হুউঁ? ঘুমুলে আর ঘুম ভাঙ্গানো যায় না রে তোর। উঠ একটু। তোর সাথে কথা ছিল। আমি বেশি সময়ের জন্য আসতে পারেনি। এখুনি আবার চলে যেতে হবে।”

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো মাহবুব। এইতো, সামনে তো আতিকই বসা!! তার প্রানের বন্ধু, আতিক, ফিরে এসেছে!

- “উঠলি শেষ পর্যন্ত!” হাল্কা করে হেসে বলল আতিক।

মাহবুবের মাথায় এই বুদ্ধিটুকু তখন কাজ করছিলো না যে আতিক জীবিত নয়- মৃত। নিজ হাতে কবর দিয়ে এসেছে সে তাকে।
আতিকের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “দোস্ত, আছিস কেমন তুই?”

একটু হেসে বলল আতিক, “ভালোই রে!”

- “তারপর কেমন চলছে সব??”
- “ভালোই! শোন, তোর সাথে খুব জরুরি কথা ছিল দোস্ত। আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমি যা বলব তা চুপচাপ শুনে যা।”
- “আচ্ছা”  সুবোধ বালকের মতন উত্তর দিল মাহবুব। ঠিক যেনও একটা ছোট বাচ্চা তার অনেকদিনের প্রিয় খেলনাটা ফিরে পেয়েছে।

- “সেদিন আমি তোদের সাথে মিট করার জন্যই রাতের বাসে পঞ্চগড় থেকে রওনা দেই। পথে আমাদের বাসটা এক্সিডেন্ট করে। ঘটনাস্থলেই আমি মারাত্মক ভাবে আহত হই। বারবার তোদের কথা মনে পড়ছিল। মারাত্মক কষ্ট হচ্ছিল রে। মনে হচ্ছিল কেউ যেনও আমার জ্যান্ত দেহটা থেকে চুরি দিয়ে কেটে কেটে হৃৎপিণ্ডটা খুলে নিচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। পৃথিবীটা যেনও লাটিমের মত ঘুরছিল। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় হাসপাতালে নেয়া হয় আমাকে। ডাক্তাররা চেষ্টা করার আগেই মারা যাই আমি।”

বিমূঢ়ের মত শুনছিল মাহবুব। প্রশ্ন করলো, “তারপর??”

“দোস্ত, এতো কষ্ট কেন হচ্ছিল জানি না। বার বার চোখে তোরা ভাসছিলি। তোদের কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি দোস্ত। পরে জেনেছি সেদিন আমার জন্য রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলি তোরা। মোতাহেরটা তো আবার একটু পাগল। ও নাকি রেগে ছিল আমার উপর। আড়ালে কেঁদেছে আমার উপর অভিমান করে!! আমাকে মাফ করে দিস তোরা। যাবার বেলায় তোদের বিদায় নিয়ে যেতে পারলাম না। শেষবারের মত দেখতে পারলাম না চামড়ার চোখ দিয়ে। আমি অনেক বেশি সরি রে। মাফ করবি তোদের এই বন্ধুটাকে??”

ঘোরের মধ্যে বলল মাহবুব, “ছিঃ, এইসব কি বলছিস তুই?”

এই পর্যায়ে মাহবুবকে জোরে ধাক্কা দেয় আসমা। “এই, কি ঘুমের মধ্যে বসে বসে বকবক করছ?? শুয়ে পড়ো!”
সাথে সাথে যেনও ঘুম থেকে জেগে উঠে মাহবুব। নিজেকে খাটের উপর বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে। সাড়া গা ঘামে ভিজে একাকার। আসনপিঁড়ি করে বসে আছে। ঠিক যেই ভঙ্গিতে বসে কথা বলছিল আতিকের সাথে।
নিজের মোবাইলের ডিসপ্লে দেখে সে। রাত ২.৫৯।

ঘটনার ৩দিন পর।

ঢাকার একটি স্বনামধন্য রেস্তোরায় বসে আছে মোতাহের, সাবু, আর মাহবুব। কারো মুখে কথা নেই। মাহবুবের বলার জন্য অপেক্ষা করছে। মূলতঃ মাহবুবের ফোন পেয়েই এখানে ছুটে এসেছে তারা।
অনেক ইতস্তত করে অবশেষে মঙ্গলবার রাতে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল মাহবুব। হঠাৎ সাবু প্রশ্ন করলো, “ঘড়িতে তখন কটা বেজেছিল মনে আছে তোর??”

“হুম। ২.৫৯।” মাহবুবের উত্তর।
বিস্মিত হয় সাবু, বলল- “আতিক আমার কাছে ঠিক ৩ টার দিকে আসে এবং ঠিক একই রকমের কথাবার্তা হয় তার সাথে। বারবার বলতে থাকে যেনও তাকে আমরা মাফ করে দেই।”

মোতাহের জানালো, তার সাথেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে।
......এবং সময় তখন ২ টা বেজে ৫৯ মিনিট !! !


ভূকা ১৭ : অভিশাপ

খুবই একরোখা স্বভাবের ছিলেন আমাদের তানিয়া খালামনি। তবে পরিচিত জনের কাছে অনেক বেশি উচ্ছল ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে যেন উনার কি হয়ে গেল! কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলেন না।
কিছুদিন পর হঠাৎ উনার হাত পা ফুলে যেতে লাগলো। তাই উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন আমার মামা। ডাক্তার অনেক কিছুই পরীক্ষা করতে দিলেন কিন্তু কিছুই ধরতে পারলেন না। ধীরে ধীরে উনার অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হতে লাগলো। অনেক ডাক্তার দেখানো হল কিন্তু কেউই কিছু ধরতে পারলেন না। এদিকে তানিয়া খালামনি দিনকে দিন আর বেশি নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগলেন। সারাদিন শুধু কান্নাকাটি করতেন।

 তানিয়া খালামনি এর কিছুদিন পর মারা যান।

 মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে উনার গায়ের চামড়া খসে খসে পড়া শুরু করে। উনার পুরো শরীর এক বীভৎস রূপ নেয়। বাড়ির সকলে এই ব্যাপারে অনেক বেশি চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারেনি। অবশেষে, ১২ই ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।
তানিয়া খালামনি মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর, যখন মোটামুটি সবাই তার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা ভুলতে বসেছে তখন তার মৃত্যুর আসল রহস্য উন্মোচিত হয়। তানিয়া খালামনির ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। মৃত্যুর কারনটা জানা যায় সেই ডায়েরি পড়ে। সেটায় স্পষ্ট ভাবে লেখা ছিল সব। তানিয়া খালামনি লিখেছিলেনঃ

“.........আজ আমি বিরক্ত হয়ে একটা বিড়ালের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেই। কিন্তু, আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দুপুরে ঘুমানোর সময় আমি বিড়ালটাকে স্বপ্নে দেখতে পাই। বিড়ালটা আমাকে ৪ টুকরো আপেল খেতে দেয়, কিন্তু, এক টুকরো খেয়েই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।”

“.........আজ আবার বিড়ালটা আমার স্বপ্নে এসেছিলো। আমি যেন শুনতে পাই যে ওটা স্পষ্ট ভাষায় বলছে, “আমাকে যেভাবে কষ্ট দিলি, তোকেও সেভাবে কষ্ট পেতে হবে।”এরপর বিড়ালটি তার আকার পরিবর্তন করে খুব ভয়ঙ্কর একটা রূপ নেয়।”


ডায়েরিতে এতটুকু পর্যন্ত লেখা ছিল।

ডায়েরির উপরের ঘটনাটুকু পড়ার পর কারোই আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ঐ বিড়ালটা কোন সাধারন বিড়াল ছিল না। বরঞ্ছ অশরীরী টাইপের কিছু ছিল। গরম পানি ঢেলে দেয়ায় বিড়ালটার গায়ের চামড়া যেমন খসে খসে পড়ে, তেমনি তানিয়া খালামনির গায়ের চামড়া ও খসে খসে পড়েছিল।


::সংগৃহীত::


ভূকা ১৬ : বাস্তবে ভূতের কোন অস্তিত্ব আছে কী ?

ভূতপ্রেত সত্যিকার অর্থে আছে কি-না এ নিয়েই অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে দ্বিধা যতোই থাকুক না কেন সব জাতের মানুষই ভূতপ্রেতের অস্তিত্বে অল্প বিস্তর বিশ্বাস করে। অদ্ভূত সব ভূতুড়ে কাহিনী আর ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। অনেকে আবার তাদের নিজেদের চোখে দেখা ভূতের কাহিনীও শুনিয়ে থাকেন। হিন্দু ধর্মে প্রচলিত বিশ্বাস হলো, ভূতপ্রেত এক স্বতন্ত্র জাতি বিশেষ। বলা হয়, মরার পর মানুষ তার কর্মফল অনুযায়ী ভূত বা অশরীরী আত্মা হয়ে দেখা দেয়। এদের নিজেদের কোনো চেহারা থাকে না আর তাই যেকোনো আকারে দেখা দিতে পারে।

এমনিতে চোখে দেখা না গেলেও ভূত যেকোনো জায়গায় দেখা দিতে পারে আবার অদৃশ্য হয়েও যেতে পারে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো- ভূতপ্রেত সবই বাস করে ভাঙা বাড়িতে, গোরস্তানে, পুকুর পাড়ে, কুয়োর মধ্যে, ছমছমে নিঝুম জায়গায়, বট-অশ্বথ গাছে ডালে। বহু জাতির মধ্যে রীতি হলো মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক শেষকৃত্য করা, যাতে তার আত্মা ভূত হয়ে ফিরে এসে মানুষকে উত্যক্ত না করে।

 বিজ্ঞানীদের মতামত এক্ষেত্রে ভিন্ন। তারা মনে করে, ভূতের অস্তিত্ব নেহাতই একটা কাল্পনিক ব্যাপার। বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের বিচারে ভূত দেখার ঘটনা হলো মন বা চোখের বিভ্রম। একটা জিনিসের সত্যি সত্যি অস্তিত্ব থাকলেও বিভ্রম দেখা দেয় যখন আমাদের চোখ বা মন তাকে অন্যভাবে দেখতে চায়।

মরুভূমিতে যে মরীচিকা দেখা যায় সেও এক ধরনের বিভ্রম। দারুণ তেষ্টায় ছটফট করতে করতে মনে হয় সামনেই যেন একটা বিরাট পুকুরে পানি টলটল করছে। তেষ্টা মেটানোর জন্য পুকুর পাড়ে পৌছতে গিয়ে দেখা যায়, যেন পুকুরটা খালি দূরে সরে যাচ্ছে। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, পানি পর্যন্ত আর যাওয়া সম্ভব হয় না। আর এ করতে করতে পথহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত মরে যেতে হয়। মরুভূমির পানি এই যে বিভ্রম ঘটে তার পেছনে রয়েছে বালির ওপর সূর্যের আলোর এক বিশেষ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। আসলে পানি তো আর সেখানে থাকে না, পানির আভাস বা বিভ্রম ঘটে যখন বালির ওপর গাছপালার উল্টো প্রতিফলন ফুটে ওঠে।

এক ধরনের বিভ্রমকে বলা হয় অমূল প্রত্যক্ষ (hallucination). এই অমূল প্রত্যক্ষ বা যা নেই তাকে দেখার ব্যাপারটা ঘটে যখন নানা কারণে মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে বা একটা সংশয় দেখা দেয়। আবার কয়েক রকম নেশা করলেও এমনটি হতে পারে। আর সে অবস্থায় মানুষ অনেক কিছুই শুনতে পায়। আশ্চর্য অদ্ভুত অনেক কিছুই দেখতে পায়। ভয়ঙ্কর ভুতুড়ে সে সব দেখে আতঙ্কিত হয়। আর তখনই ভূতপ্রেতের আমদানি হয়। কোকেন নামক নেশা জাতীয় পদার্থ খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে মনে হতে পারে, শরীরের ওপর দিয়ে যেন পোকা-মাকড় কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাই বুঝতে পেরেছেন, ভূতপ্রেতদের আসল অস্তিত্ব বাস্তবে কোথাও নেই। সবই হলো মনের ভ্রম।
ভ্রম সত্যি যাই হোক না কেন ভূতপ্রেতের চিররহস্যময়তা কখনোই ম্লান হবার নয়। কেউ বিশ্বাস করেন আর কেউ বলেন হাস্যকর।


ভূকা ১৫ : হিঙ্গুলী জামিয়া মাদ্রাসা মসজিদ

ঘটনাটা ৩১ জুলাইয়ের।

জ্বর জ্বর লাগছে সেই গতকাল দুপুর থেকে। তার ওপর প্রচন্ড গরম- কারেন্ট নেই। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করছি। ঘেমে বিছানার চাদর ভিজিয়ে ফেলেছি। ফেনারগান খেয়েছিলাম সর্দি আর কাশির জন্য। সারা দুপুর-রাত মাতালের মত বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। বার কয়েক মেঝেতে শুয়ে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। মশার কামড় শুরু হতেই আবার বিছানায় মশারির ভেতর ঢুকে পরতে হয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুম। ওষুধ খেয়ে ঘুমালে স্বপ্নে যা দেখি সব হয় আবোল তাবোল। কিন্তু গতকাল সেরকম দেখিনি। প্রত্যেক ঘুমের ছোট ছোট অংশে অনেকটা খন্ড নাটকের মত স্বপ্ন দেখেছি দুপুর থেকে একেবারে ভোর রাত পর্যন্ত। স্বপ্নটা আবোল তাবোল নয়। খুব স্পষ্ট এবং প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে আমি ঐ সময়টায় সে জায়গাতেই ছিলাম।

স্বপ্নের প্রথম অংশে আমি একটা মাদ্রাসার পুকুর পাড়ে বসে ছিলাম। যোহরের আযান দেয়নি তখনো। দেবে দেবে এমন সময়। পুকুরের সবুজ শ্যাওলা ভরা পানি দাপিয়ে মাদ্রাসার বাচ্চাগুলো গোসল করছে। আমি সিঁড়িতে বসে দেখছি তা। দৃশ্যটায় কোনো বৈচিত্র নেই। খুব স্বাভাবিক। ওদের পানির ছিটে এসে আমার গায়ে পড়ছে। শ্যাওলার জমাট পানি শার্টটা ভারি করে তুলছে ক্রমশ। এ অবস্থায় হঠাৎ খেয়াল করলাম এতগুলো বাচ্চাদের ভীড়ে পানির মাঝে আরো একজন। দেখতে অনেকটা বাচ্চা ন্যাড়া মেয়েদের মত। কিন্তু গায়ের চামড়া অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে। চুপচাপ গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেমন গা শিরশিরে অনুভূতি হল হঠাৎ।

আমার প্রথম বারের মত ঘুম ভাঙ্গল। এবং আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ের শার্টটা সবুজ শ্যাওলায় রীতিমত মেখে আছে।
শার্টের এ দশা হবার পেছনে কোনো যুক্তি সে সময়ে দাঁড় করাতে পারিনি। তারওপর কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ- কোনোটাই খাটছিল না মাথার ভেতর। লাগছিল সবটাই খুব স্বাভাবিক। মাতালের মত বিছানা থেকে সে সময় উঠে পড়তে হয়েছে, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছে ছেলেটা। সেটা রেখে দিতে হল। খাবার নেয়ার সময় আমার শার্টের এ অবস্থা দেখে কেমন ভাবে যেন তাকাতে লাগল ছেলেটা। কিছু জিজ্ঞেস করল না অবশ্য। বুড়ো মানুষের ভীমরতি ভাবল বোধ হয়।

নামায পড়ার জন্য গোসল সেরে নেয়া উচিত। তাই আর বিছানা মুখো হলাম না। যদিও এখনো ঘুমে শরীর অবশ প্রায়।
আমার দ্বিতীয় দফা ঘুম থেকে স্বপ্ন গুলো এতই জীবন্ত হতে লাগল যে আমি একবারও বুঝতে পারিনি এগুলো স্বপ্ন, এবং কোনো ধরনের প্রশ্নও জাগেনি আমার ভেতরে সে সময়।
আমি গোসল সেরে নামায পড়ে শুয়ে পড়ি। খেতে ইচ্ছা করছিল না তখন। খালি পেটেই ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। ঘুমে মাতালের মত লাগছে। শুয়ে চোখ বন্ধ করা মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

 প্রায় সাথে সাথে চোখ মেললাম। আমি মাদ্রাসার মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি। ছোট ছোট বাচ্চারা পাঞ্জাবী পাজামা পরে নামায পড়ছে আমার সামনের দিকে। আমি ওদের পেছন দিকে। কেউ আমাকে খেয়াল করছে না মনে হল। তাকাচ্ছে না কেউ আমার দিকে দেখলাম। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। চারপাশে তাকালাম। সরাসরি চোখ চলে গেল মসজিদের দান বাক্সের গায়ে লেখাটার ওপর। মসজিদের বারান্দার একটা থামের গায়ে ঝোলানো ওটা।

                                  “ হিঙ্গুলী জামিয়া মাদ্রাসা মসজিদ
                      মেহেদীনগর, বারইয়ার হাট, মিরসরাই, চট্টগ্রাম”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। টলছি মাতালের মত। আস্তে আস্তে হেটে এলাম দান বাক্সটার সামনে। ওখানে আরো একটা নতুন কাগজ টানানো দেখলাম। “অসুস্থ মাদ্রাসা ছাত্রের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন” একটা ছোট নোটিস দেয়া। বোধ হয় কোনো ছাত্র অসুস্থ। আমি মানিব্যাগ বের করে একটা দশ টাকার ছেঁড়া নোট বের করলাম। টাকা ঢোকানোর ছিদ্রটা জ্যাম হয়ে গেছে। ঢোকানো যাচ্ছে না। তালাটা খোলা। এমনি ছিটকিনিটার হুকে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। চুরি টুরির ভয় নেই মনে হয়। আমি তালাটা খুলে ছিটকিনি উঠিয়ে ঢাকনাটা খুললাম। সবে মাত্র টাকাটা ফেলেছি হঠাৎ দেখলাম উঠানে গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মাথার মেয়েটা এককোনায় বসে রয়েছে! এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!

ঝটকা দিয়ে জেগে উঠলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কারেন্ট আসেনি এখনো। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম একটা জিনিস দেখে। আমার হাতে ছোট একটা তালা! মসজিদের দান বাক্সের সেই তালাটা.........

আমার তৃতীয় দফার ঘুমটা হল শেষ বিকেলের দিকে। কারেন্ট এসেছে তখন। ক্যাপাসিটর নষ্ট ওয়ালা ফ্যানটা ঘটর ঘটর করে মাথার ওপর ঘুরছে। হাত দিয়ে ঘোরালে হয়ত আরো জোরেই ঘুরতো। চোখ বোজার সাহতে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এবারেও নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই মাদ্রাসাটায় আবার চলে এসেছি আমি।

এবার বেশ অবাক হয়ে দেখলাম মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো একটা লাশ নেয়া খাটিয়ার চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচু স্বরে ফোঁপাচ্ছে কেউ। আমি মাথা উঁচিয়ে দেখলাম। কোনো ছোট বাচ্চা মারা গেছে। কাফন দিয়ে পেঁচানো। কেবল মুখটা বার করা। চার পাঁচ বছর হবে বয়েস। জানাযা পড়ানো হবে এখন। মাদ্রাসার হুজুর-আলেমরা সহ সবাই এসে সারি করে দাঁড়িয়ে পরতে বললেন। ঈমাম সাহেব লাশটাকে সামনে রেখে জানাযা পড়ানো শুরু করলেন। আমি একরকম ঘোরের মধ্যেই নিয়ত বেঁধে জানাযায় দাঁড়িয়ে গেলাম।

এখানে অনেক লোকজন এসেছে। গ্রামের লোকজন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যে মারা গেছে- তার কেউ বোধ হয় আসেনি। অন্তত আসলে সেটা হাব ভাবেই প্রকাশ পেত। একবার সন্দেহ হল- বাচ্চাটা অনাথ না তো?

লাশটা কবর দেয়ার জন্য মসজিদের পাশের গোরস্থানের দিকে যখন নিয়ে যাচ্ছে খেয়াল করলাম গ্রামের লোক গুলো খুব অবাক মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না।

আমি নিজেও কিছুটা দ্বিধা দন্দ্বে ভূগছি। সবার সাথে আমিও কবর দিতে এলাম। প্রকৃয়াটা খুব দ্রুত হল। মাটি দেয়ার সময় কয়েক মুঠো মাটি দেয়ার পর যেই আবার মাটি নিয়েছি হাতে- দেখলাম আমার ঠিক সামনে, কবরের অন্য পাশে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা! লোকজনের আড়াল থেকে স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে......
 আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং এ দফায় আবিষ্কার করলাম আমার ডান হাতে মুঠো ভরা কাঁচা মাটি!

  শেষ স্বপ্নটা দেখি মধ্য রাতে। তখন জ্বর বেড়েছে ভীষণ। থেকে থেকে কাঁশছি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছি। জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে। ঘুম আসতে সময় নিচ্ছিল তাই। কখন ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই।
 চোখ মেলে দেখলাম আমি মসজিদের পাশের গোরস্থানটার একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে আছি। আমার ঠিক সামনেই নতুন বাঁশের বেড়া দেয়া সেই কবর। আকাশে অর্ধেক চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট একটা শব্দ পাচ্ছি গোরস্থানের ভেতর। অনেকটা ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া কান্নার মতশব্দ। কিন্তু শব্দটা কেমন যেন চাপা। আমি ভয় পেলাম হঠাৎ ভীষণ রকমের একটা ভয়। হাত পা সব অসাড় হয়ে আসতে নিল- এমন একটা ভয়...... খুব হাচড়ে পাচড়ে এক রকম উঠে দাঁড়ালাম গাছটা ধরে। চাঁদের আলোয় কবরটার দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ডের ওপর দিয়ে। আমার স্পষ্ট মনে হল কবরটা নিঃশ্বাস নেয়ার সময় যে ভাবে বুক ওঠা নামা করে- সে ভাবে বেশ জোরেই ওঠা নামা করছে! তারপর লাগল কবরের মাটিগুলো থেকে থেকে লাফিয়ে উঠে নেমে যাচ্ছে! যেন নিচ থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে বের হতে চাচ্ছে! সেই সাথে ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া গুমোট-চাপা কন্ঠস্বর!

আমি এত ভয় পেলাম যে দ্বিগ্বীদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে গোরস্থানের মাঝ দিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। তার মাঝেই দেখলাম সেই ন্যাড়া মাথার মেয়েটা একটা কোঁদাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের নিচে। হাত তুলে সেই নতুন কবরটার দিকে যেতে বলছে ইসারায় আমাকে। হাতের কোঁদালটা দেখিয়ে বোঝাচ্ছে কবরটা খোঁড়ার জন্য আমাকে!

আমি প্রচন্ড ভয়ে তখন সংজ্ঞাহীন প্রায়। পেছন থেকে আসা কবরের ধুপ ধুপ শব্দটা তাড়া করছে যেন আমাকে.........

আমি জেগে উঠি ফযরের আযানের মুহূর্তে। আমার সারা গায়ে ধূলো বালি, মাটি আর নানান জায়গায় ছিলে গেছে কাঁটার ঘষা খেয়ে...... বিমূঢ়ের মত বসে রইলাম আমি......

আমি পেশায় সরকারী চাকুরীজীবি। টাইপিস্টের কাজ করি। নিজের চলে না বলে বিয়ে থা আর করিনি। পঞ্চাশের মত বয়স হয়েছে বলে এখন আর ওসব করার চিন্তাও মাথায় আনিনা। একা একা থাকি বলে নানান রোগে শোকে ভূগি। ছোট বেলা থেকে এক ফুফুর কাছে মানুষ হয়েছি। তাকে টুকটাক সাহায্য করি এখন। এছাড়া আমার জগৎ খুব সীমাবদ্ধ। সে রাতের স্বপ্ন গুলো নিয়ে খুব যে ব্যস্ত হয়ে পরব এমন মানুষও নই আমি। একা থাকি বলে হয়ত মনের ভূলে এসব দেখেছি। শার্ট, তালা, মাটি- এসবের ব্যাখ্যা মনের ভূল বলেই হয়ত চালিয়ে দিয়ে ভূলে যেতাম পুর ব্যাপারটা। কিন্তু নিছক স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি আমি সেটাকে।

 ৩১ জুলাইয়ের বিচিত্র ঘটনা গুলো আমার পক্ষে ভূলে যাওয়া সম্ভব হল না পত্রিকায় একটা লেখা দেখে। ৩রা জুনের একটা পত্রিকায় “হিঙ্গুলী মাদ্রাসা গোরস্থানে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে জীবন্ত কবর দেয়া হয় ভূল বশত” শিরোনামে একটা আর্টিক্যাল চোখে পড়ে আমার। সব ওলোট পালট লাগতে শুরু করে তখন। কারণ সেখানে বলা হয়েছেঃ

   "৩১ জুলাই বিকালে জুবায়ের আলী নামের এক ছোট পাঁচ বছরের মাদ্রাসা ছাত্র মারা যায়। স্থানীয় ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করার পর বাদ আসর তাকে মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে কবর দেয়া হয়। পরদিন ভোরবেলা ফযরের নামায শেষে ঈমাম সাহেব কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখেন কবরের মাটি সরে গেছে অনেক। যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েছে। তাঁর সন্দেহ হলে স্থানীয় লোকজন দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় এবং সবাই বাক রুদ্ধ হয়ে দেখে কবরের কোনায় সাদা কাফন পরে ছেলেটা বাঁকা হয়ে বসে আছে। তার বসে থাকার ভঙ্গিটা খুব অস্বাভাবিক। কবরের দেয়াল জুরে ছেলেটার আঙ্গুলের আচোঁড়ের চিহ্ন। শ্বাস নিতে না পেরে দেয়াল খাঁমচে বের হবার চেষ্টা করেছিল বোঝা যায়। চোখ গুলো কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায়। পা দিয়ে কবরের মেঝে ঘষে লম্বা লম্বা খাঁজ করে মাটি উঠিয়ে ফেলেছে ভয়াবহ মৃত্যু যন্ত্রণায়!"