সিলেট নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই রোডের দিগন্ত-২৭ হাজী ভিলার নিচতলা। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুরু হয় জিকির আসকার। চলে রাতভর। গতকাল ভোর হতেই বাসার ভেতর থেকে ভেসে আসে জিকিরের সঙ্গে শোর-চিৎকার। এগিয়ে যান প্রতিবেশীরা। দরজায় কড়া নাড়েন, তবে খুলে দেয়নি কেউ। বাসার একটি রুমের জানালা দিয়ে পুলিশ ডাকতে বলেন ওই বাসার ভাড়াটে সপু চৌধুরী। সকাল সাড়ে ৭টায় পুলিশ এলে দরজা খোলেন বাসার মহিলারা। বাসার একটি রুম থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় স্কলার্সহোম কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করা মেধাবী ছাত্রী সৈয়দা মারওয়া রিফাতকে। প্রথমে তাকে নগরীর একটি ক্লিনিক ও পরে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রিফাতের ছোট ভাই সৈয়দ মারওয়ান রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার মা অনেক দিন থেকে মানসিক রোগে ভুগছেন। বাসায় জিন-ভূতের আগমন ঘটেছে বলে রাতে তিনি প্রায়ই চিৎকার করতেন। এক সপ্তাহ আগে তার মামা ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী দুবাই থেকে আসেন। দু'দিন পর থেকে মামার মধ্যেও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। বাসার কাজের বুয়া রুকিনার পরামর্শে তার মা দারস্থ হন রায়নগর দর্জিবন্দের কথিত পীর মা তফুরা বেগমের। 'পীর মা' সবকিছু শুনে বলেন, তাদের বাসায় জিন-ভূত 'আছর' করেছে। গত বুধবার থেকে তিনি জিন-ভূত তাড়ানোর চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসার জন্য একটি গরু ও এক ভরি স্বর্ণ দাবি করেন 'পীর মা'। তার চাহিদা অনুযায়ী গরু ও স্বর্ণের মূল্য বাবদ ৭৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয় বুধবার। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় পরিবারের সবাইকে পীর মায়ের কাছে নিয়ে যায় কাজের বুয়া। পীর মা তাদের 'ফুল ভেজা পানি' খেতে দেন। সঙ্গে দিয়ে দেন কয়েকটি তাবিজ এবং আরও কিছু পানি ও তেল পড়া। নির্দেশ দেন রাতভর জিকির আসকার করতে।
মারওয়ান জানায়, রাতের খাবার খেয়ে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। শুধু তার মা বাসার উত্তর পাশের রুমে উচ্চৈঃস্বরে জিকির করতে থাকেন। রাত ২টার দিকে তিনি সবাইকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বলেন, ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে জিন-ভূত প্রবেশ করছে। তিনি সবাইকে নিয়ে ওই রুমে জড়ো হয়ে জিকির শুরু করেন। কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দেন ঘরের সবক'টি ভেনটিলেটর। মুঠোফোনে পীর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরামর্শ নেন। রুমের ভেতর কাগজ ও কাপড় পুড়িয়ে সবাইকে মুখের ভেতর ধোঁয়া নিতে বলেন। পীর মায়ের দেওয়া বিকট গন্ধযুক্ত পানি খেতে দেন সবাইকে। এরপর আবারও পীর মায়ের পরামর্শ নেন মুঠোফোনে। পীর মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী বাসার সবাইকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করেন। মেয়ে রিফাত ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে রাজি না হওয়ায় 'পীর মায়ের' পরামর্শে-নির্দেশে রিফাতকে বাথরুমে ঢুকিয়ে কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে বালতির পানিতে মাথা চুবাতে থাকেন মা সিদ্দিকা চৌধুরী ও মামা ইশতিয়াক চৌধুরী। এক সময় রিফাত অচেতন হয়ে পড়ে। থানা হাজতে আটক কাজের বুয়া রুকিনা বেগম জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে পীর মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী সারা রাত জিকির করা হয়। এ সময় গৃহকর্ত্রী সিদ্দিকা চৌধুরী ও তার ভাই ইশতিয়াক চৌধুরী পরিবারের লোকজনকে মারধর করেন। 'পীর মা' তফুরার ছেলে থানাহাজতে আটক ইসলাম উদ্দিন জানান, সাত বছর বয়স থেকেই তার মা 'পীরাকি' পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সারারাত তার মা জায়নামাজে বসে রিফাতের পরিবারের জন্য দোয়া করেছেন এবং মুঠোফোনে সিদ্দিকা চৌধুরীকে পরামর্শ দিয়েছেন। সিলেট কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক নারায়ণ দত্ত জানান, কথিত 'পীর মা'কে আটক করতে তার আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কথিত পীরের বোন, ছেলে, ছেলের বৌ ও নিহতের বাসার কাজের মেয়েকে আনা হয়েছে।
ঢাকা, শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০১০, বাংলাদেশ প্রতিদিন