আমি তখন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সেকেন্ড সেমিস্টার থেকে হলে সীট বরাদ্দ দেয়া হলো। হলে উঠে পড়লাম। নীচতলার একটা রুমে চারজন থাকার ব্যবস্থা। ঘরের চারকোনায় চারটা সিংগেল বেড রাখা, সাথে একটা করে টেবিল আর চেয়ার। আর একটা বুকশেলফ। ঘরের মাঝখানে করিডরের মত লম্বা জায়গা। সেখানে একটা আলনা রাখা।
ঘরের উত্তর দিকটাতে দুটো বড় জানালা। জানালার ওপারে একটা বড় বাগান। বাগান না বলে একটা জঙ্গল বলাই ভাল। একটা মালী বাগানটা দেখাশুনা করে।
আমার বেডটা ছিল একটা জানালার সামনে। আমার পাশে আর একটা জানালার সামনে যার বেড, তার নাম জামশেদ। প্রায় ছফুটের কাছাকাছি লম্বা। মুখভর্তি দাড়ি। ঘন কালো জোড়া ভুরু । কথা বলে খুব কম। গলার স্বর ও কেমন জানি কর্কশ আর ঝঁঝালো। তার সাথে দু-একটা কথা বলার পর, কথা চালিয়ে যাবার সাহস হলোনা। অন্য দুই রুমমেট তখনো হলে এসে উঠেনি।
আমার কখনো মায়ের আচল ছেড়ে বাড়ীর বাইরে এক রাত থাকার ও অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই এমনিতেই ছিলাম ভীতু প্রকৃতির। এই রকম অন্যরকম চেহারা আর অদ্ভুত স্বভাবের বিছানা-প্রতিবেশী দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।
প্রথম দিনই রাতে ভালো ঘুম হলো না। ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। ঘুম থেকে উঠে দেখি পাশের বিছানায় জামশেদ নেই। ঘড়িতে দেখি রাত ২ টা ৩৭।
এত রাতে কোথায় গেল? আমার শীত লাগতে শুরু করলো। পানি পিপাসা লাগছে। পানি খেতে হলে ঊঠে রুমের বাইরে বের হয়ে আর ও ৩-৪ মিনিট বাগানের পাশ দিয়ে হেটে, কল থেকে ভরে নিয়ে আসতে হবে। মন কে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম, জামশেদ মনে হয় পানি খেতে অথবা বাথরুমে গেছে। বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছি। প্রায় ৩০ মিনিট কেটে গেল, জামশেদের ফেরার নাম নেই। দেশে তখনও মোবাইল এর চলন শুরু হয়নি।
আমার ততক্ষণে গলা শুকিয়ে কাঠ। থাকতে না পেরে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাড়ালাম। চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতা। জানালার বাইরে অদ্ভুত রকমের আলো-ছায়ার খেলা। সম্ভবত জোৎস্না রাতের আলো। আমি পানির জন্য ঘরের বাইরে বেরুলাম।
আমার গা ছমছম করছে। হলের বাইরে বাগানের পাশে আসতেই মনে হয় ১০ মিনিট কেটে গেল। বাগানের মাটিতে আলো-ছায়ের খেলায় এক রকম মায়াবী পরিবেশ। কিছু বুনো গাছের তলায় ঝরা পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। সেথায় হঠাত মনে হলো, একটা প্রাণীর অবয়ব। অবয়ব টা অনেক ছোট। আমি সেই ছায়াটার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। ছায়াটাকে অনুসরণ করতে করতে একটা গাছের উপরের দিকে তাকাচ্ছি। হঠাৎ আমার হাত-পা জমে উঠল। তাকিয়ে দেখি, সেই গাছটার একটা উঁচু শাখায় লম্বা লম্বা হাত-পা ঝুলিয়ে বসে আছে জামশেদ।
আমি একটা গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম। সে রাতের এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।