মধ্যরাতে কুমিরা রেলস্টেশনে

আজকে বলব আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সত্যি ঘটনা। যারা মোবাইল অপারেটর বা তাদের ভেন্ডর কোম্পানিগুলোতে কাজ করেন, তারা জানেন যে নেটওয়ার্কের মেইনটিনেন্সের জন্য প্রায়ই রাতে কাজ করতে হয়। রাতের এ কাজকে 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' বলা হয়। আমি যেহেতু একটি মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানের অপারেশন্সে কর্মরত আছি, তাই আমারও অনেক সময় রাতে 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' থাকে। 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' থাকলে সারারাত কাজ করে সকালে বাসায় ফিরি।

এবার মূল ঘটনায় আসি। প্রথমে আমার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ঘটনাটি ঘটেছিল চিটাগাং শহর থেকে সীতাকুণ্ডের দিকে যেতে মধ্যবর্তী কুমিরা নামক স্থানে। ঘটনার রাতে আমার 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' ছিল কুমিরা রেলস্টেশনের কাছের একটি মোবাইল বেসস্টেশনে। গ্রামে বিসতৃর্ণ বিশাল মাঠের মাঝে অথবা শহরে সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদের ওপরে টাওয়ার এবং তার সাথে একটি ঘর অনেকেই দেখেছেন। একেই সংক্ষেপে বলে বেসস্টেশন (আসলে বিটিএস বা বেস ট্রান্সিভার স্টেশন)। বেসস্টেশনগুলোতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। সেসব যন্ত্রপাতির মধ্যে থাকে 'রেডিও ইকুইপমেন্ট' এবং 'ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট'। ক্যাবল বা তারের সাহায্যে ল্যাপটপে ইনস্টল করা সফটওয়্যার দিয়ে এসব যন্ত্রপাতিতে লগ-ইন করতে হয়। তারপর প্রয়োজনীয় কমান্ড দিয়ে কাজ করতে হয়।
রাত দুটোয় ছিল আমার কাজ। আমি কুমিরা রেলস্টেশনে পৌঁছলাম রাত দেড়টার দিকে। তখন স্টেশনটি ছিল একদম জনমানবহীন। গাড়ি রেলস্টেশনের কাছেই রাখতে হয়; তাই ড্রাইভারকে সেখানে গাড়িটা রাখতে বলে আমি টর্চ জ্বালিয়ে রেললাইনের পাশের বালুর পথ ধরে বেসস্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চারদিকে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। রাতটাও মনে হয় ছিল অমাবস্যার। আশেপাশের কিছুই তেমন পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল না। যতদূর চোখ যাচ্ছিল, শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার! দূরের বিশাল বিশাল গাছগুলোকে কেমন জানি অতিপ্রাকৃত মনে হচ্ছিল। তবে আকাশের তারাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আকাশে ছিল অগণিত তারা; তারার ওপর তারা ঠেঁসে যেন আলোকবিন্দুর সতূপ তৈরি হয়েছে! সব মিলিয়ে সেই আধিভৌতিক পরিবেশে কিছুটা ভয় এসে ভর করল আমার ওপর। ভয়ের মতো ভয়ংকর পরজীবী বস্তু পৃথিবীতে নেই! অন্য পরজীবীদের ভ্যাকসিন বা ঔষধে মোকাবিলা বাগায়েব করা যায়। কিন্তু ভয়কে মোকাবিলা করার কোনো অস্ত্র নেই। তবে অন্য পরজীবী দেহের 'পুষ্টি' শুঁষে নিলেও ভয় শুধু চায় 'প্রশ্রয়'। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ভয়কে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি। একটু পরেই ফণা তুলে সে আমাকেই ধাওয়া করবে।
ধীরে ধীরে আমার হাঁটার গতি দ্রুত হতে লাগল। টর্চের আলো সামনে ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা কুচকুচে কালো রঙের বিশালাকৃতির বিড়াল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। অতিমাত্রায় নিস্তব্ধ পরিবেশে কানে বোধহয় ধাপা ধরে গিয়েছিল। চারপাশের কোনো শব্দই কানে আসছিল না। টর্চের আলোতে বিড়ালের জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। খানিক বাদে বিড়ালটাই উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। আমি সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত হেঁটে বেসস্টেশনে পৌঁছলাম। বেসস্টেশনের রুমের মধ্যে ঢুকেই রুমের লাইট জ্বালানোর পর যেন জানে পানি ফিরে পেলাম।
সে রাতে একসাথে আরও কয়েকটা বেসস্টেশনে অপটিক্যাল ফাইবার নিয়ে কাজ হচ্ছিল। বিভিন্ন লোকেশনে থাকা ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ অন্য বেসস্টেশনে থাকা এক ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ার সামান্য ভুলের কারণে নেটওয়ার্ক ডাউন হয়ে গেল। নেটওয়ার্ক ডাউন হওয়াতে কারও সাথে তখন যোগাযোগের কোনো উপায় নেই, তাই আমি নেটওয়ার্ক আপ হওয়ার অপেক্ষায় চুপচাপ বসে রইলাম। 'বিপদ যখন আসে, চতুর্দিক দিয়েই আসে'-এই কথাটার বক্তাকে খুঁজে বের করে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত। অতি সত্যি একটি কথা। আমিও এর সত্যতা হাড়ে-হাড়ে টের পেলাম। কারণ কয়েক মিনিট পরেই চলে গেল বিদু্যৎ! মুহূর্তেই আমার পুরো শরীর ভয়ে জমে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নিজেকে কেমন জানি ওজনহীন মনে হচ্ছিল; পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেছে! অন্ধকারে মনে হলো, কোনো কালো ছায়া আমার ঘাড়ের পেছনে রক্তমাখা দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। ঝট করে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালাম। মনে হলো, কালো ছায়াটাও স্থান পরিবর্তন করে আবার আমার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে। শুনেছি, মানুষ ভয় পেলে বৃক্কীয় গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন মানুষকে শান্ত ও স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। কিন্তু আমি শান্ত হওয়া তো দূরে থাক, আরও অস্থির হয়ে উঠলাম। কারণ, মনে হচ্ছিল ছায়াটা ধীরে ধীরে আমার চারপাশে বিসতৃত হয়ে আমাকে গিলে ফেলতে চাইছে। আমি আড়চোখে ডানে-বামের দেওয়ালে তাকাতেই সেই কালো ছায়াকে যেন প্রসারিত হতে দেখলাম। টর্চ জ্বালিয়ে হুড়মুড় করে বাইরে চলে এলাম। গাড়ি যেদিকে দাঁড়ানো ছিল, সেদিকে জোরে হাঁটা ধরলাম।
আবারও মনে হলো, একটা ছায়া আমাকে ফলো করছে। এবারও একদম উল্টো ঘুরে পেছনে টর্চ মারলাম। সামনে যতদূর চোখ গেল, কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে দূর থেকে টাওয়ারের মাথায় চোখ পড়তেই মনে হলো, সেখানে কেউ বসে আছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, কেউ একজন টাওয়ারের ওপরে বসে পা দুলাচ্ছিল। আর স্থির থাকতে পারলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে গাড়ির দিকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম।
অল্প সময় দৌড়ানোর পরই একটা লোককে আমার দিকে আসতে দেখলাম। কিছুটা শান্ত হলাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে গায়ে চাদর জড়ানো লোকটির মুখ ছিল একপ্রকার অস্পষ্টই। লোকটি যখন আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন আমার দিকে তাকাতেই আমি আঁতকে উঠলাম। ভয়ংকর সেই লোকটা কিছু একটা চিবিয়ে খাচ্ছিল। সবচেয়ে ভয় পেলাম, তার মুখের চারপাশে লেগে থাকা রক্ত দেখে। 'ওয়াক থু' বলে সে মুখে জমে থাকা কিছু পরিমাণ রক্ত বালুর পথের ওপর ফেলল। তারপর আমার দিকে অগি্নদৃষ্টিতে তাকাল। লোকটির চেহারায় ছিল অস্বাভাবিক কাঠিন্য! চেহারা স্পষ্ট দেখতে না পাওয়াতে আমার কাছে আরও বিকটদর্শণ মনে হচ্ছিল। তখন আমাকে ভয় এতটাই গ্রাস করেছিল যে, মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়া ড্রাকুলা দেখতে যেমন হয়, লোকটিকে আমার স্রেফ তেমনই মনে হচ্ছিল! আমি কোনো দিক না তাকিয়ে দিলাম দৌড়। একটু সামনে গিয়ে পেছনে টর্চ মেরে দেখি লোকটা নেই। আর বেশি কিছু চিন্তা না করে দৌড়াতে লাগলাম। গাড়িতে কাছে পৌঁছে মনে হলো, নতুন জীবন ফিরে পেলাম।
ইলেকট্রিসিটি আসার পর আবার টর্চ জ্বালিয়ে বেসস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। রেললাইনের পাশের বালুর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেসস্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পায়েহাঁটা রাস্তার বালুতে, আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া লোকটির পায়ের ছাপগুলো দেখে আমি শিউরে উঠলাম। লোকটির পায়ের ছাপগুলো ছিল উল্টো!
পাদটীকা: আমার এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যা আমি বের করতে সক্ষম হয়েছি। আসলে প্রচণ্ড ভয়ে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিল। এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে জানতে পেরেছি, হ্যালুসিনেশন হলে এমনটা হতে পারে। বেসস্টেশনের কালো ছায়া অথবা টাওয়ারের ওপরে বসে পা দুলাতে থাকা জলজ্যান্ত মানুষ ছিল আমার হ্যালুসিনেশনের ফল। আর আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া লোকটি আসলে পান চিবাচ্ছিল। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম বলে ইলিউশনের কারণে তার মুখটা আমার কাছে রক্তামাখা ও বিকৃত মনে হয়েছিল। পরে কাজ শেষে সকালে ফেরার সময় রেললাইনের পাশের বালুর পথে পানের পিক পড়ে থাকতে দেখেছি। সেই জায়গাতেই লোকটা মুখ থেকে রক্ত ফেলেছিল বলে আমি ভেবেছিলাম। পানের পিক প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল বলে চিনতে অসুবিধা হয়নি। আর লোকটির পায়ের ছাপ আমাকে সেই মুহূর্তে ভয় পাইয়ে দিলেও সেটা আসলে সেই পথ ধরে হেঁটে যাওয়া অন্য কোনো মানুষের পায়ের ছাপ ছিল। ঐ লোকটির পায়ের ছাপ ফেরার পথে দেখতে পেয়েছি। এ ধরণের ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে ভৌতিক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। আর আমরা যখন তা কাছের মানুষদের কাছে বলি, তখন তা আরও রোমহর্ষক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে।

প্রথম দেখা ভূত

আমি যখন ছোট ছিলাম কখনোই বাবা-মাকে ছাড়া ঘুমাতাম না। এভাবে প্রায় ৮ বছর পর্যন্ত বাবা-মার সাথেই ঘুমিয়েছি। আর ভূত দেখার পরে তো বাবা মার সাথে না থাকার প্রশ্নই থাকে না।

যাই হোক , ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের। তখন আমার বাবার পোস্টিং ছিল কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানায়। আমার বাবা ছিলেন একজন ভূমি দখল কর্মকর্তা ঐ সময়ে । আমি সব সময় আমার বাবা মার মাঝখানে ঘুমাতাম। কিন্তু আমার একটি খারাপ অভ্যাস ছিল। বাবা ঘুমিয়ে নাক ডাকা শুরু করলেও আমি ঘুমাতাম না। আমি অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতাম। প্রায় ১- ১.৫ ঘন্টা পরে আমি ঘুমিয়ে যেতাম।
একদিন প্রত্যেক দিনের মত আমি বাবা মার মাঝখানে শুয়ে পড়লাম। বাবা লাইট অফ করে দিলেন। এবং তারা ঘুমিয়েও পড়লো। কিন্তু আমি আমার অভ্যাস অনুযায়ী অন্ধকারে দড়জার বাইরে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি যেখানে শুয়ে ছিলাম সেই ঘরের দড়জা দিয়ে ৩-৪ মিটার দূরে ডাইনীং রুম পার করে রান্না ঘরের দড়জা দেখা যায়। প্রায় ৫ মিনিট তাকিয়ে থাকার পরে কেন জানি মনে হচ্ছিল ঠিক দড়জার মাঝে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে সন্দেহ হলো হয়তোবা আমি ভূল দেখছি। কিছু সন্দেহ কিছুক্ষনের মাঝেই উবে গেল। দেখি কেউ একজন অন্ধকারে নড়ে উঠলো। ব্যাপার টা কি রকম ? আচ্ছা। একটি আবছা আবাছা অন্ধকারের মধে যদি কোন কালো … অধিকতর গাড় কালো কোন বস্তু নড়তে দেখেন ঠিক সেরকম। হটাৎ করে নড়তে শুরু করলো। হ্যা , আমি বুঝতে পারছি এটি এদিকেই এগিয়ে আসছে। অনেক সুন্দর করেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না। আমার তখন যায় যায় অবস্থা। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। এদিকে আব্বু আম্মু দুজনেই ঘুমাচ্ছে। কালো আকার টি প্রায় আমাদের ঘরের দড়জার কাছে চলে এসেছে। আমি স্পষ্ট দড়জার পর্দার ফাকে দেখতে পাচ্ছি।
আমার মনে আছে যখন সে দড়জার পর্দা হাত দেয় তখনই আমি এত জোড়ে চিৎকার মারি যে আব্বু আম্মু লাফিয়ে উঠে পড়ে। আমি ভূত ভূত করে চিল্লায় উঠি। আব্বু আমাকে ভয় নেই বলে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। লাইটের আলোয় আমি তখনো দেখতে পাচ্ছি পর্দা নড়ছে। আব্বু – আম্মু আমাকে ভয় নেই বলে সান্তনা দিয়ে লাইট বন্ধ করে দেয়। আম্মু বলে হয়তবা স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আমি এখনো মনে করতে পারি কি ঘটেছিল সেইদিন।
হয়তো বাবা মা আমি ছোট ছিলাম বলে তেমন গুরুত্ব দেননি । কিন্তু আমার মনে এখনো তা গেথে আছে। পরে শুনেছিলাম ঐ বাসার পিছনে একটই ছেলে পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল। এর সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক ছিলো কিনা আমি বলতে পারবো না। এটা কি ভূত ছিল নাকি অন্য কিছু ছিল। আমি তা ঠিক বলতে পারবো না। আপাতত এটিকে আমি ভূত বলেই চালিয়ে দিচ্ছি। এরকম যদি আর অন্য কেউ দেখে থাকেন তাহলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন । সুপার ন্যাচারাল জিনিসে আমার আগ্রহ ছোট বেলা থেকেই। আমি জানিনা এর রহস্য কি ? … শুধু জানি আমি দেখেছিলাম....

যাদুবিদ্যা ও ডাইনীতন্ত্র!!

 যাদুবিদ্যা ও ডাইনীতন্ত্র!!

যাদুবিদ্যা আর যাদুকর এই দুইয়ের প্রতিই মানুষের আগ্রহ সীমহীন সেই মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। পৃথিবীর মানুষের লোকসংস্কারের এটা বড় অংশই হলো যাদুবিদ্যা।
যাদুবিদ্যা মূলত: অতিন্দ্রিয় আর প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার বিদ্যা! ইংরেজি ম্যাজিক শব্দের উদ্ভব হয়েছে ফার্সি মাজি থেকে! মাজিরা যে সব ক্রিয়া-কর্ম পালন করতো, গ্রীকরা তাকেই ম্যাজিক বলে অভিহিত করতেন!
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমজাবিদ আর নৃত্বাত্তিকগণ সমাজে প্রচলিত যাদু বিধান গুলো পর্যালোচনা করে এদের বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ করার চেষ্টা করেছেন। যেমন স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের মতে যাদুবিদ্যার বিধাব গুলো প্রধানত দুই রকমের.........
Homeopathic Magic:
১। এই যাদু বিধান সর্বকালে সব দেশে শত্রুর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে শত্রুর প্রতিমূর্তি (মোম, মাটি, কাঠ, কাপড়), বা ছবি ইত্যাদি তৈরি করার করে পুড়িয়ে, বা ছুড়ি দিয়ে কেটে ধ্বংস করা হয়! ধারণা এই যে, মূর্তিটা যে যন্ত্রনা পাচ্ছে, শত্রুও তেমন যন্ত্রনা বা আঘাত পাচ্ছে। এটাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে!
তবে এই যাদু আবার অনেক সময় মানুষে উপকার বা ভালর জন্যেও ব্যাবহার করা হয়। যেমন ইন্দোনেশিয়ার সমুত্রা দ্বীপে একটা এমন একটা যাদু বিধান আছে-------কোন নারীর সন্তান হচ্ছে না, তখন করা হয় কি একটা কাঠের ছোট শিশু বানিয়ে নি:সন্তান রমনীটি কোলে বসিয়ে আদর করে! এর ফলে তার সন্তান হবে এমন ভাবা হয়!
কখনো কখনো রোগের চিৎকসার জন্যও এই ধরণের যাদুর প্রয়োগ দেখা যায়! যেমন প্রাচীন হিন্দু সমাজে জন্ডিস (পান্ডুর) রোগের চিকিৎসার জন্য মন্ত্র পাঠ করে রোগীর চোখের হলুদ অংশ সূর্যের কাছে পাঠানো হত!!
২।Contagious Magic:
এই ধরনের যাদু বিধানের মাধ্যমে বিশ্বাস করা হয় মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশেষ যেমন চুল, নখ, থুথু বা পরিধেয় বস্ত্রের মাধ্যমে যাদু করে মানুষের ক্ষতি বা উপকার দুটাই করা সম্ভব! মালয়ে এমন এক ধরনের যাদু বিধানের প্রচলন দেখা যায়---শত্রুর আঙ্গুলের নখ, চুল, ভ্রু, থুথু ইত্যাদি সংগ্রহ করে মোমের সাহায্যে শত্রুর একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে তা ছয় দিন ধরে মোমের আলোয় ঝলসাতে হবে এবং সাত দিনের দিন মূর্তিটি পুড়িয়ে ফেললে শত্রুর মৃত্যু হবে!
ভুডু পুতুল
যাদুবিদ্যার ধরন আর প্রাকরভেদ নিয়ে অনেকে অনেক মত দিয়েছেন, তাদের সকল মতবাদ সমূহ একসাথে করেলে বলা যায় যাদুবিদ্যা প্রধাণত তিন ধরণের.........
১। সৃজনধর্মী যাদু বা হোয়াইট ম্যাজিক: ফসলের ভাল উৎপাদন, বৃষ্টি আনা, গাছে ভাল ফল হওয়া, প্রেম বিয়ে হবার ইত্যাদির উদ্দেশ্য ব্যবহৃত যাদু। এটাকে বলা হয় হোয়াইট ম্যাজিক।
২।প্র‌তিরোধক যাদু: এই যাদুও হোয়াইট ম্যাজিকের মধ্যেই পরে। এটা বিদপ আপদ এড়ানো, রোগব্যাধির দূর করা আর কালো যাদুর প্রভাব এড়াবার কাছে ব্যবহার করা হয়!
৩।ধ্বংসাত্মক যাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিক : রোগব্যাধি সৃষ্ট, সম্পত্তি ধ্বংস, জীবন নাশের কাজ ব্যাবহার করা হয়, ডাইনি বিদ্যায় এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায়! এটাই হলো ব্ল্যাক ম্যাজিক।
সেই প্রাগঐতিহাসিক কাল থেকে আজও পর্যন্ত এর প্রভাব দেখা যায় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর!
যাদুবিদ্যার প্রাচীন ইতিহাস যদি আমরা খুজে দেখতে চাই তাহলে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই প্যালিওলিথিক যুগের গুহামানবদের গুহাচিত্রের দিকে। অরিগেনেসিয়ার নামক গুহায় বেশ কিছু মুখোশ পরা মানুষ আর জন্তু জানোয়ারের ছবি দেখা যায়, যেখানে মানুষগুলোর হাতের আঙ্গুলের প্রথম গিট পর্যন্ত কাটা! যদিও নৃত্বাত্তিকেরা এদের কুষ্ঠরোগ আক্রান্ত মানুষ বলে বর্ননা করেছেন, তবে যাদুবিদ্যা বিশারদদের মতে মৃত্যুকে জয় করার জন্যই হাতের আঙ্গুল কেটে তা নিবেদন করার রীতি সে আমলে প্রচলিত ছিল। দেহের অংশ বিশেষ দিয়ে গুন (ব্লাক ম্যাজিক) করার রীতি বাংলাদেশেও দেখা যায়!
প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ গুলোতেোও নানা আঙ্গিকের যাদুবিদ্যা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায় সমসাময়িক ধর্মগুরু আর জনগনের !
পারস্যের জোরেয়াস্তার (আনু: ১০০০ খ্রি:পূ) মাজিয়ান ধর্মের প্রচলন করেছিলেন যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ভাল ও মন্দের মধ্যের ভালোর জয় লাভ। কিন্তু পরে এ ধর্মমতের মধ্যে যাদুবিদ্যার উদ্ভব হয়! মাজিয়ান ধর্মের ধর্মীর আচার অনুষ্টান গুলো পালনের নেতৃত্ব দিত যারা তাদের বলা হয় মাজি! এই মাজিরা মূলত: জ্যোতিষী, গনৎকার হিসাবে পরিচিত ছিল, এরা সূর্য, চন্দ্র, মাটি, পানি বাতাস প্রভৃতির উদ্দ্যেশে শিশু ও পশু বলি দিয়ে দেহ রক্ত শুদ্ধ করত!
ইহুদিদের বাইবেল(ওল্ড টেস্টেমেন্ট) যাদুবিশ্বাসের উল্লেখ আছে,
"মোশি যখন সদাপ্রভুর অস্বিত্ব নিয়ে জনগণের সন্দেহের কথা বলছিলেন তখন সদাপ্রভু তাকে বললেন "তোমার হস্তে ওখানি কি? মোশি কহিলেন ষষ্টি, তখন তিনি কহিলেন, উহা ভুমিতে ফেল। পরে তিনি তা ভুমিতে ফেললেন, ষষ্টি সর্প হইলো। তখন সদাপ্রভু বলিলেন উহার লেজ ধর...মোশি সাপের লেজ ধরা মাত্রই তা আবার লাঠি হয়ে গেল! "
আল-কুরআনের সুরা বাকারা (৩৫ রুকু, ২৬৯ আয়াত) একটি অংশের কথাও উল্লেখ করা যায় :
"আরও স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, ইব্রাহীম যখন বলিয়াছিল: হে আমার প্রভু, মোর্দ্দাকে তুমি জেন্দা করিবে কিভাবে, তাহা আমাকে দেখাইয়া দাও। আল্লাহ ইরশাদ করিলেন:তবে তুমি ইহা বিশ্বাস কর নাই, ইব্রাহীন উত্তরে বলিল, হাঁ (বিশ্বাস করি) তবে আমার অন্ত:করণ স্বস্তিলাভ করুক এই জন্য (প্রার্থনা); আল্লাহ বলিলেন: তাহলে তুমি চারটা পাখি গ্রহণ কর এবং সেগুলোকে নিজের প্রতি অনুরক্ত করিয়ে লও, তাহার পরে সেগুলো আলাদা আলাদা চারটি পর্বতের উপর রাখিয়া তাহার পর ডাক দাও সেগুলোকে-দেখিবে তাহারা ছুটিয়া আসিতেছে তোমার কাছে----"
তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে যাদুবিদ্যার নিন্দাবাদ করা হয়েছে।
মূলত: হযরত মুহাম্মদ স এর নবুয়ৎ প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত সেমেটিক জাতি গুলোর মধ্যে ব্যাপক ভাবে যাদুবিদ্যা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়!
মেসোপটেমিয় সভ্যতা গুলো থেকে যাদুবিদ্যার প্রচুর ট্যাবলেট পাওয়া গিয়েছে, যেখানে তিন শ্রেনীর পুরোহিতের কথা বলা হয়েছে----বারু,এরা ছিল যাদুকর ও গুনিক, এরা মৃত প্রানীর যকৃৎ, নাড়ি ভুড়ি দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করতো। অসিপু নামের আরেক শ্রেনীর পুরোহিত ছিল ওঝা, এরা ভুত প্রেত তাড়াত!
তবে যাদুবিদ্যায় যারা সবচাইতে বেশি ভূমিকা রেখেছে তারা হলো প্রাচীন মিশরীয়রা। চতুর্থ রাজবংশ প্রতিস্ঠা হাবার আগে থেকেই মিশরে ব্যাপক হারে যাদুবিদ্যার চর্চা শুরু হয়! ভুত প্রেতের আছর থেকে শুরু করে রোগব্যাধীর নিরাময় এমন কি সাপে কাটলেও তার প্রতিকারের জন্য আলাদা আলাদা যাদুবিদ্যার আশ্রয় নিত এরা, আর এইসব কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা ওঝা ছিল! এরা নিগ্রো আর এশিয়ার মৃত নারীর আত্মা সম্পর্কে খুব ভয় পেত, আর ভয় করতো নিজের আত্না হারানোর! তারা মনে করতো যাদুকরেরা ইচ্ছা করলে যাদুর সাহায্যের অন্যের আত্মাও চুরি করতে পারে! তৃতীয় রামেসেসের সময়ে হুই নামের এক যাদুকর সম্রাট রামেসেস ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের মূর্তি বানিয়ে এর মাধ্যেম রামেসেসের বংশ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রও করেছিল একবার। ইহুদির মিশরে বন্দী অবস্থায় অবস্থানের সময়েই মিশরীয় যাদুবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল! অবশ্য তাদের নিজেদেরও আলাদা বৈশিষ্ট্যময় যাদু বিশ্বাস ছিল।তাদের বিশ্বাস মতে স্বর্গভ্রষ্ট আদম পৃথিবীতে যাদুবিদ্যাসংক্রান্ত একটা বিশেষ বই এনেছিলেন, যার নাম দ্যা বুক অব রাজিয়েল! আবার কারো কারো মতো স্বর্গভ্রষ্ট ফেরেশতা উজ্জা ও আজাইল একজন নারীকে যাদুবিদ্যার গান শিখিয়েছিলেন।
ইহুদি যাদুকরেরা বাস্পস্নানের মাধ্যমে বলি আর উপহার দিয়ে অতিপ্রকৃত শক্তিকে বশ করার চেষ্টা করতো! এদের যাদু চর্চায় স্হূল যৌনাচার হত এছাড়া অল্পবয়স্ক বালকদের ব্যাবহার করতো অতিন্দ্রীয় শক্তির সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে। তারা মনে করতো যাদুবিদ্যার সবার পক্ষে আয়ত্বকর সম্ভব না, শুধু মাত্র বিশেষ দক্ষ ব্যাক্তিদের পক্ষেই এটা সম্ভব আর এই বিশেষ দক্ষ ব্যাক্তিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো কিং সলোমন! তার ' কি অফ সলোমান' বইটা পরবর্তীকালে যাদুবিদ্যার সর্বশ্রেষ্ট বই হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ গুলোতেও যাদুবিদ্যা আর ধর্মের একটা জটিল সংমিশ্রন দেখা যায়! স্বপ্নব্যাখ্যাও প্রাচীন যাদুবিদ্যার অঙ্গরূপে স্বীকৃতি পেয়েছিল।
যেমন কৌশিক সূত্রে অনিষ্টকারী ভুত প্রেতাত্মাকে তারানোর জন্য সেই অশুভ শক্তির উদ্দ্যেশ্যে পাখি যে ডালে বাসা বাধে, সেই ডালের লাকড়ি দিয়ে রান্না করে খাবার উৎসর্গের কথা বলা আছে। কিছু বৈদিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে বলি দেয়া পশুর নাড়ি ভুড়ি ও অন্যান্য অংশ রাক্ষস আর সাপকে উৎসর্গ করা হতো!
এখনকার সমাজেও এমন অনেক বৈদিক যাদুবিদ্যাগত প্রক্রিয়া এখনও চালু আছে। হরপ্পা মহেঞ্জোদারতে উৎখননে প্রাপ্ত রিং স্টোন গুলো যাদুবিদ্যায় ব্যাবহার করা হতো বলে জন মার্শাল ধারণা করেন। বলা হয় কেউ যদি এর পাশ দিয়ে যায় তাহলে তার পাপ খন্ডন হব! যেমন আফজাল খানকে হত্যার পরে পাপ খন্ডন করার জন্য শিবাজী এই পাথরের তলা দিয়ে পার হয়েছিলেন!!
হরপ্পান রিং স্টোন, ধারণা করা হয় এগুলো যাদুবিদ্যায় ব্যবহার করা হতো! জাপানের প্রাচীন শিন্টো ধর্মের মধ্যে যাদুবিদ্যার প্রচুর উদাহরণ দেখা যায়। জাপানিরা বিশ্বাস করে চালের মধ্যে ব্লাক ম্যাজিক প্রতিহত করার বিশেষ শক্তি আছে, এছাড়া রাস্তার সংগমস্থলও তাদের কাছে বিশেষ ভাবে পবিত্র। এসব স্থানে তারা এখনও জননেন্দ্রীয়ের প্রতিক চিন্থ স্থাপন করে, বিশ্বাস করে এই প্রতিক অশুভ শক্তিকে দূরে সরিয়ে রাখবে!জাপানিদের মতো চীনাদের ভুত প্রেত সম্পর্কে বেশ ভালই ভয় ভীতি ছিল। মজার ব্যাপার হলো, চীনের ঘরবাড়ি ও পুল নির্মানে একটা বিশেষ দেবতা চীনদের প্রভাবিত করেছে, এই দেবতার নাম হলো শা'। শা হলো একটা অপদেবতা, আর চীনারা বিশ্বাস করে এই অপদেবতা সব সময়ে সোজা রেখা বরাবর চলে, তাই এটাকে প্রতিহত করার জন্য চীনা স্থাপত্যশিল্পে ছাদে এত বক্রতা আর কোণ!
পরবর্তি কালে তাওবাদ যেমন চীনা লোকসংস্কারকে প্রভাবিত করে, তেমন করেছিল কনফুসিয়াস। কনফুসিয়াসের 'আই চিং' প্রধানত ভবিষ্যৎ গননার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল।
যাদুবিদ্যা চর্চায় প্রাচীন গ্রীক আর রোমানরাও কম ছিলেন না।যাদুবিদ্যার দেবী হেকেটি।
যাদু বিধান প্রয়োগের জন্য বিশেষ স্থানে নির্বাচিত করা হতো, যেমন গোরস্তান বা রাস্তার সংগমস্হল! গ্রীকরা যাদুবিদ্যার জন্য বিশেষ বর্নমালার সৃষ্টি পর্যন্ত করেছিল, এগুলো লেখা হতো পবিত্র কালি দিয়ে আর লেখার সময় বার বার পাঠ করা হতো, কারণ ধারণা করা হতো এভাবেই যাদুকর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারি হতে পারবে! ওয়ার উলফের ধারণটাও এদের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল! এছাড়া এরা ফেব্রুয়ারি শেষ বা মার্চের প্রথম সপ্তাহে তিন দিন ধরে প্রেতাত্মাদের উদ্দেশ্য একটা বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করতো, এখনও করে।
রোমান জনসাধারণ 'বদ নজর' (evil Eye) কে বিশ্বাস করতো! তারা মনে করতো কুনজর লাগিয়ে মানুষ থেকে শুরু করে শস্য গবাদি সব কিছুরই ক্ষতি করা সম্ভব! এই ধারণটা আমাদের দেশেও এখনও দেখা যায়! ছোট ছোট শিশুদের কপালে বা পায়ের নিচে কাজলের টিপ লাগিয়ে কুনজর দূরে রাখার রিতী এখনও প্রচলিত আমাদের দেশে!
অন্যান্য জাতিদের মতোই রোমানারও ভবিষ্যত জানবার সকল উপায় উদ্ভাবন করার চেষ্টা করেছিল। রোমান যাদুকরেরা স্বপ্ন বিচার, কোষ্ঠি বিচার থেকে শুরু করে নারী বশিকরন করার জন্য নানারকম প্রসাধনীও ওঝারা বিক্রী করত!
এখানে একটা কথা না বললেই নয়, বর্তমানের রূপচর্চার বহুল ব্যাবহৃত প্রসাধন দ্রব্য শুরুতে শুধু যাদুবিদ্যার কাজেই লাগানো হত!
এভাবে প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন সভ্যতায় মানুষের জীবন ও কল্পনায় যাদুবিদ্যা প্রভাব বিস্তার করতে থাকলেও মধ্যযুগে এসে এটা দানবীয় রূপ ধারণ করে। আর যাদুবিদ্যার পরিবর্তীত রূপে শয়তানবাদের চর্চা বেশির ভাগ দেশেই পূর্নতা পায়! এই সময়ে যাদুবিদ্যার যে নিরংকুশ চর্চা হয়, তা ছিল নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, লালসায় ভরপুর!
এই সময়ে প্রতিটা যাদুকরকে শয়তানের কাছে বিশেষ প্রক্তিয়ায় চুক্তি বদ্ধ হতো। সকলেই দাবী কর‌তো যে সে কোন দেব-দেবীর নৈবর্ক্তিক শক্তিকে আয়ত্ব করে রেখেছে।
সাপ, ব্যাঙ, বিড়াল ও পেঁচা মধ্যযুগীয় যাদুবিদ্যায় অবশ্যকীয় পশু-পাখি হিসাবে গণ্য করা হত। লোকের ধরণা ছিল আংটি, শিশি, বোতল ও বাক্সে ভুত প্রেত, দৈত্য দানোকে বন্দী করে রাখা সম্ভব! এখন এসব শুনতে হাস্যকর লাগলো, সে সময়ে এটাই ছিল বাস্তব!
শয়তানের প্রতিক হলো শিং। ব্লাক ম্যাজিক চর্চায় শিং অপরিহার্য!
এই সময়ের একজন বিখ্যাত যাদুকর ছিলেন যোহান রোসা। তার একটা মন্ত্রপুত অংটি ছিল, যেটায় একটা প্রেত্মাত্মাকে তিনি আটকে রেখএছিলেন আর এটাকে দিয়ে সব কাজ করাতেন! তার মৃত্যুর পরে প্রকাশ্য জন সভায় আংটিটা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেংগে ফেলা হয়ছিল্!
গর্ভবতী নারীদের প্রসব বন্ধ করা থেকে শুরু করে যৌনাকাঙ্খা চিরতার্থ করার মত বিভৎস সব যাদু বিধানের চর্চা হতো তখন। এসময়ে বিশ্বাস করা হতো বশিকরণের মাধ্যমে মানুষকে দাস বানিয়ে রাখা যায়। যে কোন বিপদজনক কাজে যাবার আগে 'প্রয়োজনীয় মন্ত্রপুত জামা" পরে যাবার রিতী ছিল, কুমারী মেয়ের বড়দিনের এক সপ্তাহ ধরে এই ধরনের জামা ঘরে বুনত। 'বান' ছোড়ার কথা বাংলাদেশে অপরিচিত নয়, মধ্যযুগের এই (Magical Arrow) ধারণাটার ব্যাপক প্রচার ছিল। বিশ্বাস করা হতো এভাবে মানুষের ক্ষতি করা সম্ভব!
মধ্যযুগে রেনেসাঁর আলো যতই ছড়াক না কেন, জ্যোতিষীদের হাত থেকে কেউই রক্ষা পায়নি! অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক অস্তিরতা প্রভৃতি কারণে জনমানসে তখনও ভবিষ্যত জানার প্রবল স্পৃহাই এর কারণ ছিল। পরবর্তি কালে হাজার হাজার ঐন্দ্রজালিক, ডাইনি হত্যা করা হয়েছিল।

বিশাল ভৌতিক গবেষণা

 ১। মোহিনী - এটা একটা পেত্নী। এরা সাধারণত: সেই সব মেয়েদের আত্মা যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিয়ের আগেই আত্মহত্যা করেছে। এরা সুন্দর সুন্দর ছেলেদের মোহিত করে নিয়ে যায় এবং তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এরা খুব প্রতিশোধপরায়ণ!

২। শাকচুন্নী - এরা সাধারণত: সেই সব বিবাহিত মেয়েদের আত্মা যারা তার বা স্বামীর পরকীয়ার জন্য জীবন দিয়েছে। এরা হয় খুব পুরুষ-লোভী বা পুরুষ-বিদ্বেষী ।
৩। শাকিনী - এরা সাধারনত: সে সব মেয়েদের আত্মা যারা বিয়ের পরে অসুখে বা নির্যাতনে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। তারা মোহিনীদের মত অত মারাত্মক না হলেও নির্যাতনকারী স্বামী বা শ্বশুর বাড়ীর লোকদের ওপর আক্রোশ থেকে আক্রমণ করে।
৪। ডাকিনী - এরা সাধারনত: সে সব মেয়েদের আত্মা যারা অসময়ে কোনো কারণে মারা গেছে। মোহিনী, শাকিনী বা শাকচুন্নী সবাই ডাকিনীর অন্তর্ভুক্ত।
৫। চোরাচুন্নী - এরা সাধারণত: সেই সব মেয়েদের আত্মা যারা জীবনে চোর ছিলো। পুরুষ চোরেরা হল চোরাচুন্না বা চোরাভুত। এরা মরার পরও চুরি ছাড়তে পারে না।
৬। ডাইনী - এরা অত্যন্ত সুন্দরী মেয়েদের আত্মা। এদের ডাইনী বুড়ি বলা হলেও এরা কোনোদিন তাদের রুপ যৌবন হারায় না।
৭। ব্রহ্ম দৈত্য - এরা সাধারনত: হিন্দু ব্রাহ্মণদের ভুত। এরা খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে কিন্তু উল্টাপাল্টা হলেই মারাত্মক অভিশাপ দিয়ে বসে।
৮। মামদো ভুত - হিন্দু শাস্ত্র মতে এরা সাধারনত মুসলমান পুরুষ ভুত!
৯। পেচা পেচী - এই আত্মা গুলো পেচা বা পেচির মত রুপ নিয়ে বনে জংগলে বাস করে এবং মানুষ দেখলে খেয়ে ফেলে।
১০। নিশী - এরা ছেলে মেয়ে উভয়ে হতে পারে। তান্ত্রিকরা এদের লালন পালন করে এবং অন্য মানুষকে বশ করার বা ক্ষতি করার কাজে লাগায়। এরা পর পর তিন বার মানুষ এর নাম উচ্চারন করতে পারেনা বিধায় অন্ধকারে এদের দু ডাকের মধ্যে উত্তর নেয়া উচিত নয়।
১১। স্কন্ধকাটা - এসব ভুত/পেত্নীদের মাথা থাকে না!
১২। দৈত্য - এরা পুরুষ আত্মা যারা ভীষন শক্তিশালী হয় শারীরিকভাবে। এরা অদৃশ্য থাকে না এবং এদের হাতে গদা বা মুগুর থাকে!
১৩। আলেয়া - এসমস্ত ভুত/পেত্নী জলাশয়ে বসবাস করে এবং মাঝি বা জেলেদের ভয় দেখায়। এরা সাধারণত ধোয়ার আকারে থাকে! অনেক সময় এরা আবার উপকারও করে থাকে!

পুরোটাই লম্বা লম্বা পশমে ভর্তি

নাফিস উজ্রাত নামের আমার একটি বন্ধু ছিল যে জানালার পাশে শুতে খুব পছন্দ করত। জানালার পাশে শুলে জানালা দিয়ে বাতাস আসে, ঘুমটা ভালো হয়। তার বড় ভাই কিরণ কুমারও জানালার পাশে শুতে চাইতো। তাই প্রতি রাতেই তার বড় ভাইয়ের সাথে সে মারামারি করতো জানালার পাশে শোবার জন্য।


একদিন রাতে নাফিস উজ্রাতের বড় ভাই কোন এক কারণে বাসায় ছিল না। তাই সেদিন সে একাই ঘুমাতে আসে।

জানালাটি খোলা ছিল, আর নাফিস উজ্রাত জানালার ঠিক পাশেই শুয়ে ছিল। মাঝ রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার মনে হল যে কোন একটি হাত তার বুকের উপর রয়েছে। যেটি নাফিস উজ্রাতের বুকের উপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

নাফিস উজ্রাতের রুমের ডিম-লাইটটি জ্বালানো ছিল। সে চোখ মেলে হাতের মত কিছু একটা দেখতে পেলো। হাতটি সাধারণ মানুষের হাতের চেয়ে দিগুণ। পুরোটাই লম্বা লম্বা পশমে ভর্তি। হাতের মত জিনিসটা তাকে জানালার দিকে টানা শুরু করলো। নাফিস উজ্রাতরা থাকতো ৪ তলায়। সেখানে কোন মানুষে উঠার কথা না।

নাফিস উজ্রাতের মুখ দিয়ে তখন কোন শব্দ বের হচ্ছিল না।

টানা টানি করতে করতে এক পর্যায়ে নাফিস উজ্রাতের হাত জানালার গ্রিলের বাইরে নিয়ে গেল। এবং খুব জোরে জোরে হেচকা টান মারতে লাগলো যেন সেই হাতটি তাকে এই গ্রিলের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়েই বের করে নিয়ে যাবে।
নাফিস উজ্রাত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

বড় ভাই কিরণ সকালে এসে নাফিস উজ্রাতকে উদ্ধার করে। জানালার গ্রিল থেকে বের করার পর তার হাত এবং পা বেঁকে গিয়েছিল। যেটি ভাল হতে অনেক দিন লেগেছিল।

খুব সম্ভবত একারণেই পরে নাফিস উজ্রাত ভালো একজন ফুটবলপ্লেয়ার হয়।

বোবায় ধরা

 বেশ কিছু দিন আগের কথা, আমি তখন ঢাকায় খুব ছোট একটা রুমে একাই থাকতাম। প্রায় সময় আমি রাতে রেডিওর বিভিন্ন প্রোগ্রাম গুলো শুনতাম।


সেই দিন আমি রাতে ভুত এফএম শুনছিলাম। খুবি ভয়ংকর একটা গল্প শোনাচ্ছিল। শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে। আমি আর আমার হাত, পা এবং কি আমার শরীরের কোন অংশই যেন আর নড়াতে পারছিনা। মুখ দিয়ে যে কাউকে ডাকবো সেই কাজটাও করতে পারছিনা। অনেক সময় ধরে ঐ অবস্থায় থাকতে হল।

বারবার মানে হচ্ছিন আমাকে মনে হয় ঠিক জীনে ধরেছে। প্রায় ২০ মিনিটের মত হবে। আবার আমি সেই আগের মত সাভাবিক হয়ে গেলাম। পরে আর সেদিন রাতে ঘুমাতে পারলাম না।

এরপরে আমি বিভিন্ন ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, এবং অবশেষে আমি বের করতে পারলাম এই রকম হলে এটা থেকে বাঁচার সহজ উপায়।

এই সমস্যাটাকে বলে স্লিপ প্যারালাইসিস। সহজ বাংলায় আমরা যাকে বলি বোবায় ধরা।



কঙ্কাল কানাবেল

 ......:::::: কঙ্কাল কানাবেল ::::::......


স্টেশনের লোহার গেটটা এক ধাক্কায় খুলে দৌড় দিলাম টিকিট কাউন্টার এর দিকে। অনেক রাত হয়ে গেছে, ট্রেন পাব কিনা জানিনা। টিকিট কাউন্টারের সামনে যেয়ে হতাশ হতে হল আমকে।

বন্ধ।
কিন্তু কিছু করার নাই আমার, এইখানে অপেক্ষা করা ছাড়া।
একটা টুল দেখে বসে পড়লাম সেখানে।

আজকে সকালেই জয়দেবপুর এসেছি এক বন্ধুর বাসায়, সেইখান থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এখন উল্লুকের মত বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নাই। কখন ট্রেন আসবে কে জানে। বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসে গেছিল।

হঠাৎ কানের কাছে কে যেন চিৎকার করে উঠল “ পেয়ে গেছিরে”।
চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। এবার আমার চিৎকার দেওয়ার পালা। দেখলাম কিম্ভূতদর্শন দুইটা কঙ্কাল আমার সামনে দাঁড়ানো।
“ কি ভেবেছিলিরে টংরা, তুই লুকিয়ে থাকলে আমরা তোকে খুঁজে পাবনা?” একটা কঙ্কাল বলে উঠল।
“ টংরা কে”, বললাম আমি, ভয়ে ঘেমে উঠেছি।
“কে আবার , তুই টংরা। তাড়াতাড়ি চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে”, বলল অন্য কঙ্কালটা। এই কঙ্কালটার আবার একটা পা নাই।
“ কোথায় যাব?”
“ যেন কিছু বোঝেনা, তোর আজকে বিয়ে না, তাড়াতাড়ি চল।”
“ বিয়ে!”, চমকে উঠলাম আমি “কিসের বিয়ে, কার বিয়ে?”, গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ বের হল।
“তোর বিয়ে, বট গাছের পেতনীর সাথে। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে আসলি, আর এখন কিছু বুঝতে পারছিস না?”, বলল এক পায়াটা।
“আমি তো মানুষ, আমার পেতনীর সাথে বিয়ে হয় কিভাবে? ”, বললাম আমি।
“কে বলল তুই মানুষ, মড়া মানুষের ভিতর লুকালেই মানুষ হয়ে যায় নাকি?”
“মড়া মানুষ? আরে মড়া পাচ্ছেন কোথায়, আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ, দেখছেন না? মরলে আমি টের পেতাম না? ”
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল একপায়াটা।
“ওরে, মানুষ কখন মরে তা কি সে টের পায়?” বলল সে।
“সে কি তাহলে কি সত্যিই আমি মরে গেছি?” চমকে উঠলাম আমি।
“হ্যারে হ্যা, তুই মরে গেছিস রে, আর আমাদের টংরা তোর পেটের মধ্যে থেকে কথা বলছে।”

চোখে পানি চলে আসল আমার। হায়, জীবনে তো ধরতে গেলে এখনও কিছুই দেখিনি। প্রেম করিনি, নাইট ক্লাবে যাইনি। সবইতো এখনও করা বাকি।
শেষ পর্যন্ত কিনা এভাবে বেরসিকের মত মরলাম?

“যেতে কি হবেই?”, একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ হবে না আবার?”, ধমক দিল প্রথম ভূতটা “ তোর না গায়ে-গু হয়ে গেছে।”
“গায়ে গু আবার কি?”
“মানুষের যেমন গায়ে হলুদ হয়, তেমনি আমাদের হয় গায়ে গু, কিছু বুঝিস না?” বলল প্রথম কঙ্কাল টা।

হায়, সব আশা বুঝি শেষ। শেষ পর্যন্ত বোধহয় আমকে বট গাছের পেতনীকেই বিয়ে করতে হবে। বট গাছের পেতনী দেখতে কেমন হবে কে জানে? তবু ও একটা শেষ চেষ্টা করা যাক।
“ দেখুন আমি বোধহয় মরিনি, আমকে ছেড়ে দিন”, বললাম আমি।
“ কোন ভূত যখন কোন মড়ার ভিতরে ঢুকে পরে, তখন সেই মড়াটার চেহারা সেই ভূতটার মতো হয়ে যায়। দেখনা, তোর চেহারাও টংরার মতো কেমন অকুৎসিত হয়ে গেছে।”, বলল একপায়াটা।
চেহারা আমার ভালোনা, এটা ঠিক। তাই বলে এমন অপমান? আমাকে বলে অকুৎসিত? মানে কুৎসিতের চেয়েও কুৎসিত?
“ দেখেন ভাল হচ্ছেনা কিন্তু। আমি কোন টংরা ফংরা না”, একটু ঝাঁঝের সাথে বললাম আমি।
“তুই যে টংরা না মানুষ, তার কোন প্রমাণ দিতে পারবি?”

প্রমাণ? একটু ভাবলাম আমি।

“হ্যা পারব।”, বললাম আমি।

“কি প্রমাণ?”
“আমি কবিতা লিখতে পারব। আপনাদের টংরা কি কবিতা লিখতে পারে?”
“ কবিতা?” আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল একপায়াটা। “কবিতার নাম শুনলেও তো আমাদের টংরা অশ্বথ গাছে উঠে পালায়। ”
“ব্যাস, এইতো প্রমাণ হয়ে গেল যে আমি টংরা না” খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“আগে প্রমাণ কর তুই কবিতা লিখতে পারিস, তারপর বুঝব”, বলল প্রথম কঙ্কালটা, “তোর কবিতা কখনও ছাপা হয়েছে?”
“আমার কবিতা এতটা উচ্চমানের, যে সেটা ছাপালে অন্য কবিরা আর সুযোগ পাবে না। তাই ছাপা হয়নি। একজন সম্পাদক নিজের মুখে আমাকে একথা বলেছেন।” গর্বের সাথে বললাম আমি।
“দেখি লেখতো একটা কবিতা। আমার নাম নিয়ে একটা কবিতা লেখ।”, বলল প্রথম কঙ্কালটা।
“নাম কি আপনার?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“কানাবেল”, বলল প্রথম কঙ্কাল টা।

“আহা, নামের কি বাহার!”, মনে মনে বললাম আমি।
যাই হোক ব্যাগ থেকে কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলাম কবিতা লিখতে।
কিছুদূর লেখার পর জিজ্ঞেস করল কঙ্কালটা, “কিরে লেখা হল?”
“হ্যা শেষ।”
“পড়তো দেখি।”

একটু গলা খাঁকারি দিয়ে পরতে শুরু করলাম আমি,

“তেল আছে, টেল আছে
আর আছে কদবেল,
মেল আছে, জেল আছে
আর আছে পাস ফেল।
খুন আছে, চুন আছে
আর আছে বানডেল
সবচেয়ে মহান হল
কঙ্কাল কানাবেল।”

“ বাহ বাহ”, আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল কানাবেল।
“তাহলে প্রমাণ হলোতো যে আমি টংরা না?”, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কি যেন বলতে যাচ্ছিল কানাবেল, কিন্তু তার আগেই চিৎকার করে উঠল একপায়াটা, “পেয়েছি পেয়েছি টংরাকে, ওই যে অশ্বথ গাছের উপরে।”

কানাবেল আর একপায়া দৌড় দিল গাছটার দিকে।

আমিও একছুটে স্টেশন পার হয়ে শহরের দিকে ছুটলাম।

কুচিসাকে ওন্না

 কুচিসাকে ওন্নাঃ

এই নামের অর্থ হচ্ছে ‘ওমান উইথ স্প্লিট মাউথ’/ মুখ কাটা যে নারীর। জানা মতে, এই নারীকে গভীর রাতে একলা চলতি পথে দেখা যায়। তার পরনে থাকে ট্রেঞ্চ কোট এবং মুখ ঢাকা থাকে সার্জিকাল মাস্কে। একলা কাউকে পেলে হুট করে সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি দেখতে সুন্দর?’ যদি উত্তর না হয় তবে সে কাচি দিয়ে মাথা কেটে ফেলে। আর যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তবে সে তার সার্জিকাল মাস্কটি সরিয়ে তার এক কান থেকে অন্য কান পর্যন্ত কাটা মুখ দেখিয়ে বলবে, ‘এখন?’ আপনার উত্তর না হলে মরতে হবে এবং উত্তর হ্যাঁ হলে তার নিজের মতো কাটা দাগ সে পথিকের মুখে তৈরি করে দিয়ে যাবে।

বোতলে জ্বিন বন্দী

 আমার নানা পাকিস্তান আমলের একজন ঠিকাদার ছিলেন।সাথে সাথে বোতলে জ্বিন বন্দীর দক্ষতা থাকার কারনে তাকে গ্রামের লোকজন ফকির নামে চিনত।এই কাজ টি অত্যন্ত ঝুকিপুর্ণ।জ্বিন যদি কোনভাবে ছাড়া পেয়ে যায়,তাহলে আমাদের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।কিন্তু নানা সচেতন থাকার কারনে সেই ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি।নানা বলেছিলেন,তিনি খুব অল্প সংখ্যক জ্বিন কেই বোতলে পুরেছেন।এটি একটি সাধনার মত এবং সাধারনত সুরা পড়ার মাধ্যমে করা হয়।বলা হয়ে থাকে,এই পদ্ধতিতে শুধু বদ জ্বিন রাই কাবু হয় যারা অকারণে কারো ওপর চড়াও হয় কিংবা মেয়ে দের ওপর ভর করে।প্রত্যেক জ্বিন ই বোতলে বন্দীর পর ছেড়ে দেয়ারজন্যে আকুতি মিনুতি করত,নানা সবাইকেই তওবা করিয়ে ছেড়ে দিত।তবুও নানা গ্রামে গেলে খুব সতর্ক থাকতে বলতেন।বলাবাহুল্ য কিছু কথা উল্লেখ করা যেতে পারে,

১>পুকুরে একা একা গোসল করা যাবে না।
২>সন্ধ্যার পরে চুন,চুল এ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না।
৩>রাতের বেলায় মাছ,মিষ্টি খেয়ে সুপাড়ি চাবানো।
৪>গভীর রাতে কেউ ডাকলে তাকানো যাবে না,সে ডাক যদি ৩ বার হয় তাহলেই তাকানোর হুকুম আছে।
৫>নানার গলার স্বরে কেউ ডাকলেই তার মিষ্ট কথায় না ভুলে তার ছায়া এবং পায়ের পাতা দেখে নিশ্চিত হতে হবে সে আদৌ মানুষ কিনা।
নানী ভয়ে সন্ধ্যার পর বের হত খুব কম,আমাদের কেও দিত না।আমারা ছোট মানুষ,ভয় থেকেও রাতের আধারে গানের কলি খেলার ঝোক টাই বেশী থাকত।একবার নানা একটা সাপ রূপী জ্বিন কে বোতলে পুড়ে।কিন্তু নানী রাতের আধারে সেটি কে কেরোসিনের বোতল মনে করে মুখ খুলে ফেলেন এবং বিকট গন্ধে অপ্রস্তুত হয়ে নানা কে ডাকতে থাকেন।নানা দোয়া দরূদ পরে জ্বিন টাকে বোতলে ভরার আগেই সেটি পগাড়পার হয়েযায়।বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে নানা ঘর বেধে দেন এবং খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।কিন্তু শেষ রক্ষা হওয়ার আগেই বড় মামা সাপের কামড় খান,তার পুরো শরীর নীলাভ হয়ে যায়।সারা রাত চেষ্টা করেও কোন কবিরাজ বিষনামাতে পারেনি।সোনার ঢোলক ব্যবহার করে সাপে কামড়ানো রোগী কে বাচানো যায় বলে গ্রাম দেশে প্রবাদ আছে।নানা সেই চেষ্টা ও করেছিলেন।কিন্তু তাতেও ফল হয় নি।তারপর ১দিন মামার জ্ঞান ফিরলো।তার নীলাভ বর্ণ তখন আর নেই।আচমকা সুস্থ হওয়ার ঘটনায় পুরো গ্রাম বাসী অবাক।নানা ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।কিছুদিন পর নানা স্বপ্নে দেখলেন,কেউ একজন তাকে বলছে,এটা নমুনা সবে।এভাবে গোটা পরিবার শেষ হবে।নানা বাড়ি বাধালেন,ইমাম সাহেব কে কয়েকদিন বাড়িতে রাখলেন।ইমাম সাহেবের বশে কিছু ভাল জ্বিনছিল।তারা নাকি তখন বাড়ি পাহাড়া দিত।এভাবেই দিন যাচ্ছিল।আমাদের আর কোন সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায় নি।নানা গত হলেন।তার নির্দেশ অনুযায়ী সব ঠিক ঠাকমতই চলছে।না চলার কারণ তো ছিলই না,হুকুমের বাইরে এক পা এগুলেই যে কোন বিপদ প্রাণ টা নিয়ে যাবেনা এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারত?এর পর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ঘটনা ঘটে।যেমনঃ
১>একদিন মাঝ রাতে বড় মামার ঘুম ভেঙ্গে যায়।তিনি তার লেপের ওপর একটি মোটা সাপ আবিষ্কার করেন।খুব জোরে চেচান তিনি।সবাই এসে সাপ টাকে মেরে ফেলে।সেটি ফণা তোলা ছাড়া কাউকে ছোবল মারারবদ সাহস দেখায় নি।
২>ছোটবেলায় আমি একদিন পুকুরে গোসল করার সময় পাশেরলেবু গাছে একটা সাপ দেখি।পুকুরে আমি একাই নেমেছিলাম,সাতার তখন ও জানিনা।আমিও চিতকার করলাম।সাপটির দিকে তাকিয়ে।সবাই আসার সাথে সাথে সাপ টি উধাও হয়ে গেল।ভয়ের কথা হচ্ছে,সাপ টিরদিকেই আমি সবসময় তাকিয়ে ছিলাম,সেটি কে আমি কোথাও যেতে দেখিনি,অদৃশ্য হতে দেখেছি।
৩>এক রাতে আমরা বৈঠক ঘরে গল্প করছিলাম,হঠাত এক খালারআর্ত চিতকার।আমরা লাইট নিয়ে ছুটে যাই।সেখানে পার্শ্ববর্তী নারিকেল গাছের শিকড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না।অথচ খালার ভাষ্যমতে একটি সাপ তার দিকে ফণা তুলেতাকিয়ে ছিল।
৪>একবার ভর দুপুরে রান্না ঘরের টিনের চালে সাপ পাওয়া যায়।এবার ও বড় মামার ওপর আক্রমন।সাপ টা ছোবল দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু অন্য মামা রা লাঠি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করায় সেটির পক্ষে বাচা আর সম্ভব হয় নি।নানা বলেছিল,বাড়িতে ভুতপ্রেতের আগমন ঘটলে কুকুর রা অহেতুক ডাকাডাকি করে।সে দিন ও কুকুর গুলো খুব চিতকার করছিল।
৫>একবার গ্রামের বাড়ি তে গিয়েছিলাম ঈদ উদযাপন করতে।রাতের বেলা ভাত খেয়ে হাটছিলাম।বোনের চিতকারে বাড়ির দিকে ছুট দিলাম।সেও সর্প দর্শনেও ভীত।
আমার বাবা ও কখনো আমাদের নানুর বাড়ির ওই ঘর টায় থাকতে চান না।তিনি একবার মাঝ রাতে সাপবিষয়ক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন। কেমন হবে যদি মাঝ রাতে আপনিও আপনার বিছানায় সাপ দেখতে পান?সেটি আমাদের কারোর ই কাম্য নয়।