ভূতুড়ে কাহিনী ৮৩: দীঘির পাড়ে ভাঙ্গাচোরার শব্দ

 

রাজার বাড়ি ঝিটকার কাছে ছয়য়ানি গালা গ্রামে। এবার ঝিটকা

স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অনেক ভাল পাশ দিয়ে মানিকগঞ্জ

দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। মহাদেবপুর, ঝিটকা, হরিরামপুর,

ঘিওর এই সব জায়গার কয়েকজন ছাত্র মিলে একটা বাড়ি ভাড়া

নিয়ে মেসের মত থাকে। এক মহিলা তিন বেলা রান্না করে দিয়ে

যায়। মানিকগঞ্জ তখন মহকুমা শহর হিসেবে খুব বড় কিছু নয়,

মোটামুটি ছোট এক শহর। শনিবারে ক্লাস করে সবাই যার যার

বাড়ি চলে যায়। সোমবার সকালে আবার দেখা হবে। বাড়ি থেকে

আসার সময় কারো মা এক ঝুরি চিড়া, কারো জন্য কিছু পিঠা

আবার কেউ কিছু নারকেল গুড় দিয়ে দেয় তাই নিয়ে আসে।

সবাই মিলে খায়। একবার রাজার মা এক টিন মুড়ি দিয়ে দিয়েছিল

সেই মুড়ি খেয়ে মহাদেবপুরের দ্বিজেন সাহা আবারও বায়না

দিয়েছে। রাজা তোর বাড়ির মুড়ি ভীষণ সুস্বাদু তুই যখনই বাড়ি

যাবি তখনই কিন্তু অন্তত আমার জন্য এক টিন মুড়ি আনবি। রাজা

এবার বাড়ি এসে আগেই মাকে বলে দিয়েছে মা দ্বিজেনের জন্য

এক টিন মুড়ি দিও। রাজার কলেজে যেতে আর মাত্র দুই দিন বাকি আছে এর মধ্যে

মুড়ি ভাজতে হবে। রাজার মায়ের মুড়ির চিন্তায় ঘুম হয় না।

শীতের দিনে পাড়ার সব বৌ ঝিরা বাপের বাড়ি চলে গেছে। মুড়ি

ভাজবে কাকে নিয়ে? কয়দিন দেরি করেও কাউকে না পেয়ে শেষ

পর্যন্ত নিজে একাই ভাজবে বলে রাতে সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে

যাতে ভোরে উঠে একা একাই শুরু করা যায়। ঘুম হয়েছে কি

হয়নি তাতে কি আসে যায়! পুব আকাশ ফর্সা হবার আগে, পাখিরা কিচির মিচির শুরু করার

আগেই রাজার মা বিছানা ছেড়ে মুড়ি ভাজার চাউল, হাড়ি পাতিল

ঝাঁজর এই সব কিছু এনে চুলার পাশে রেখে বাঁশের চালার তৈরি

রান্নাঘরের পিছন থেকে কলার পাতা কাটতে গেছে তখন দেখল

ইয়া লম্বা কে যেন সাদা দবদবে পোষাক পড়ে রান্না ঘরের পিছন

থেকে সরে বাড়ির ঢালু দিয়ে বন কচু, ছিটকি, মটকার আগাছা

ভেঙ্গে পিছনের পুকুরের উপর দিয়ে হেটে পার হয়ে জংলা ভিটার

দিকে চলে গেল। আস্তে করে কয়েকটা কলার পাতা কেটে এনে

চুলার পাশে রেডি করে রাখল। চুলা জ্বালিয়ে দুই এক খোলা মুড়ি ভাজা হয়েছে মুড়ির ঘ্রাণ সারা

বাড়িতে ছড়িয়ে আশে পাশে পৌঁছেছে এমন সময় রান্না ঘরের

পিছনে ঝোপ ঝাঁরে প্রচণ্ড ভাঙ্গা চোরার শব্দ শুনতে পেল রাজার

মা। একটু ভয় পেল কিন্তু চুলায় আগুন জ্বলছে বলে সে ভয়কে

প্রশ্রয় দিল না। এদিকে ওই ভাঙ্গা চোরার শব্দ বেরেই চলেছে।

এভাবেই আরও কয়েক খোলা ভাজা হয়ে গেল। রান্না ঘরের

মেঝেতে খেজুর পাতার পাটির উপর পুরনো শাড়ি বিছিয়ে বালি

পরিষ্কার করার জন্য মুড়ি রাখতে হচ্ছে। রাজার মা চুলা ছেড়ে রান্না ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলল - এই তোরা

কে এমন হুড়াহুরি করছিস, তোরা একটু থামতো! সাথে সাথে নাকি সুরে , মুড়ি দে! মুড়ি দে আমরা বাড়ি যাই! - কোন বাড়ি যাবি?- ওই যে পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছে। - আচ্ছা

ঠিক আছে হুড়া হুরি করবি না চুপ করে থাক মুড়ি ভাজা হলে

দেব। এখন থাম। নাকি সুরে জবাব এলো, বেলা উঠে গেলে লোকজন চলাফেরা শুরু

হবে তখন আমরা থাকব কেমনে? এখনই দিয়ে দে! - আচ্ছা মুড়ি পাইলে চইলা যাবি? নাকি সুরে, হ যামু! আচ্ছা নে! এই বলে একটা ছোট ঝুরি ভরে কিছু মুড়ি ছিটিয়ে দিল

ওই দিকে যেখান থেকে হুরাহুরি জড়াজড়ির শব্দ আসছিল।

অন্ধকারে বিশেষ কিছু দেখতে পেল না কিন্তু ভোরের আলো ফুটে

উঠলে দেখল কোন মুড়ি পরে নেই।পরের দিন পরে রাজা মুড়ির টিন নিয়ে মানিকগঞ্জে চলে গেল।

সহসা আর কোন ছুটি নেই। আবার সেই এসএসসি পরীক্ষার

সময় ছুটি। মুড়ি পেয়ে দ্বিজেন মহা খুশি, মজা করে মুড়ি খায়। এর

মধ্যে শুধু ক্লাস আর ক্লাস। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যেন প্রায়

তিন মাস হয়ে গেল। এবার বিশ দিনের ছুটি। খালি মুড়ির টিন

আর গাট্টি বোচকা নিয়ে রাজা বাড়ি আসছে। ক্লাস শেষ করে ছুটি

হলো বলে রওয়ানা হতে বেলা পরে গেল। কলতার কাছে আসার

আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। আট মাইল পথ হেটে আসা সহজ কথা

নয়। অন্ধকার রাত বলে একটু ভয় ভয় করছিল। কলতা থেকে

কোন সাথি সঙ্গী পায় কিনা সে আশায় ছিল কিন্তু কলতা এসে

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কাউকে না পেয়ে একাই হাটতে শুরু

করল। কলতার পুল পার হয়ে ঝাউ তলা এসে একজনকে পেল

সে বিজয়নগর যাবে। বেশ তবুও কিছুটা সঙ্গী হলো। হাটতে

হাটতে আলাপ করতে করতে বেশ অনেকটা পথ প্রায় বিজয় নগর

বাজার পর্যন্ত এসে সঙ্গের লোকটা ওপাড়ে নিমতা চলে গেল। রাজা

একটু ভাবনায় পড়ল সোজা গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে নাকি চকের

মধ্যে দিয়ে ভুসকুরা হয়ে সোজা যাবে! না অনেক হাটা হয়েছে

সোজা যাওয়াই ভাল হবে এতটা পথ ঘুরে যাবার এমন কি

দরকার! বেশ, সেই অনুযায়ী বাম দিকে ভুসকুরার রাস্তা দিয়ে হেটে

আসছে। অন্ধকারে গ্রামের মেঠো পথে হেটে যাচ্ছে আর লোক

বসতি একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে। গেরস্ত বাড়ির পিদিমের

আলো ম্লান হয়ে আসছে, দেখা যায় না।এক সময় ভুসকুরার সেই বিখ্যাত দীঘির কাছে এসেছে পরে

দীঘির পাড় থেকে কেমন যেন ছট ফটানির মত শব্দ পাচ্ছে পুকুর

পাড়ে যে সব আগাছা থাকে সেগুলি ভাঙ্গা চোরার মত কেমন শব্দ।

মনে হচ্ছে কোথাও কিছু তছনছ করে ওলট পালট করছে কেউ।

যেন কোন আক্রোশ ঢেলে দিচ্ছে কারো উপর! কি হচ্ছে? কোথায়

হচ্ছে? এত অন্ধকারে কি হতে পারে, কে হতে পারে? রাজা একটু

দাঁড়াল। শুধু ওই শব্দ হচ্ছে জন প্রাণীর কোন সারা শব্দ নেই,

কিন্তু এই শব্দ কে করছে! অবাক হয়ে অনেকক্ষণ এদিক ওদিক

দেখল কিন্তু কিছুই পেল না। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে তেমন কিছু

দেখাও যাচ্ছে না। একবার ভাবে ডেকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু

কাকে জিজ্ঞেস করবে? তবুও কি মনে করে একটু জোরে ডাকল

কে, কে ওখানে? কারো কোন সারা নেই! আবার ডাকল, কে? কে

ওখানে? এবারও কোন সারা নেই তবে ওই শব্দটা যেন হটাত

করেই থেমে গেল। আশ্চর্য! আর কোন শব্দ নেই! রাজা বুদ্ধি করে

পাশের শেওড়া গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে সাথের মুড়ির টিন

ঢোলের মত বাজাতে শুরু করল। তাক ঢুমা ঢুম, তাক ঢুমা ঢুম।

বাজাতে বাজাতে যেখান থেকে শব্দ আসছিল প্রায় তার কাছে চলে

আসল কিন্তু অন্ধকার বলে সঠিক জায়গাটা বুঝতে পারছিল না।

তবুও অন্ধকারের মধ্যেই যতটা পারে হাতরে হাতরে কাছে এসে

দেখ হ্যাঁ এইতো এইখানেই ঝট পটানি হয়েছে কিছু টানা হ্যাচরাও

হয়েছে মনে হলো! মনে হল কাউকে টেনে দীঘির পাড়ে চালায়

তুলে নিয়েছে, হ্যাঁ এইতো তাজা ডাল ভাঙ্গার চিহ্ন। এমন দেখেই

রাজার একটু ভয় ভয় করতে লাগল, গা ছম ছম করে উঠল। মনে

হলো শরীর ঘামতে শুরু করেছে। ওদিকে দীঘির কিনারা থেকে

একটা অস্পষ্ট গোঙানির মত শব্দ পাচ্ছিল। এবার রাজা পুরোপুরি

ভয় পেয়ে গেল। না আর এখানে থাকা যাবে না। ডিটেকটিভ গিরি

করার কোন দরকার নেই যার যা হয়েছে হোক বাবা আমি চললাম

বলে বাড়ির দিকে এক দৌড়। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখে

আব্দুলের বাবা আর বড় ভাই হারিকেন নিয়ে এদিকে আসছে।

ওদের দেখে রাজা দাঁড়াল।রাজা কি মানিকগঞ্জ থেকে আসছ?হ্যাঁ চাচাতা এ ভাবে দৌড়চ্ছ

কেন, একেবারে হাঁপাচ্ছ, ভয় পেয়েছ নাকি?হ্যাঁ চাচা, বলেই

ভুসকুরার দীঘির পাড়ে যা দেখেছে সব খুলে বলল। শুনে

আবদুলের বড় ভাই বললকি জানি আমাদের আবদুল তো সেই

সন্ধ্যার আগে গরু নিতে এসেছিল কিন্তু গরু বাড়ি চলে গেছে অথচ

ও যায় নি! কোথায় গেল আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি।রাজার কি মনে

হলো বললচলেন তো দেখি, আমার মনে হয় ওই ওখানে দীঘির

পাড়ে দেখতে হবে। আমি অন্ধকার বলে ভাল করে দেখতে

পারিনিআচ্ছা চলো।ওরা হারিকেন নিয়ে আগে আগে আর পিছনে

রাজা চলল।কিছুদূর গিয়ে দীঘির পাড়ে এসে রাজা দেখিয়ে দিল

এইযে এখানে আমি দেখেছিলাম কিছু ছিটকির ভাঙ্গা ডাল।দীঘির

পাড়ে চালার উপরে উঠে যেখানে গোঙানির শব্দ শুনেছে সেখানে

গিয়ে দেখে অচেতন আবদুলের দেহ অর্ধেক পানিতে আর বাকি

অর্ধেক কাদায় পরে রয়েছে। এই দেখেই ওদের কারো বুঝতে

বাকি রইল না কি হয়েছে। দোয়া কালাম পড়তে পড়তে ওখান

থেকে তিনজনে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করে

যখন সুস্থ করল তখন আবদুল বলল আমি গরুর খুঁটি উঠিয়ে

ছেড়ে দিয়েছি আর অমনিই গরুগুলি এক এক করে বাড়ির দিকে

চলে এলো আমি আসছিলাম কিন্তু মনে হলো কে যেন আমাকে

জোড় করে পিছনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথচ কাউকে দেখছি না।

বেশ কিছুক্ষণ ধ্বস্তা ধ্বস্তি করলাম কিছুতেই ছাড়া পেলাম না একটু

পরেই আর আমার কিছু মনে নেই।রাজা জিজ্ঞেস করল, তখন কি

অন্ধকার হয়ে আসছিল?হ্যাঁ অন্ধকার তো গরু ছাড়ার সময়েই হয়ে

আসছিল, তখন অন্ধকার হয়ে গেছেবুঝেছি তখনই আমি শব্দ

পেয়েছি কিন্তু কিছুই দেখছিলাম না আবার ভয় করছিল বলে মুড়ির

টিন বাজাচ্ছিলামআবদুলের ভাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা তোমার টিন

বাজাবার শব্দ শুনেছি!