দপ করে নিভে গেলো হারিকেনের
আলো। কিছু বুঝে ওঠার
আগেই মুশফিকের কাঁধ স্পর্শ
করলো ঠাণ্ডা হাত। এ হাত
ড্রাকুলার, মুশফিক নিশ্চিত, হাতটি
ওর না হয়ে পারেই না।
পোড়াবাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে
এসেছে ড্রাকুলাটি। মুশফিকের
পেছনে এখন সাঙ্ঘাতিক বিপদ।
কী করা যায়, কী করা যায়। দূর
ছাই, কিছুইতো করার নেই। ভাবতে ভাবতেই কালো অন্ধকারে
মিলিয়ে গেলো পোড়া সলতের লাল
আলোটাও। দরদর করে ঘাম
ঝরছে মাথা থেকে। শিরায় শিরায়
হুটোপুটি করছে গরম রক্ত।
আকুলিবিকুলি করে ওঠলো
মুশফিক। আর বুঝি রক্ষে নেই।রক্ষে হবে কী করে, নিজেইতো
ডেকে এনেছে নিজের বিপদ।
বিদ্যুৎ চলে গেলো। ব্যস
সুবোধ বালকের মতো ঘুমিয়ে যাবে। তা
না, মাঝ রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে ভাবতে বসলো পোড়াবাড়ি রহস্য
নিয়ে। যেন এর একটা কিনারা
করেই ছাড়বে। এবার হলো তো!
বড়রা সবসময়ই মানা করেন- কখনো
পোড়াবাড়ির চৌহদ্দি মাড়াবে
না, ক্লাসের পড়া চুরি করে মাসুদ রানা-তিনগোয়েন্দা পড়বে না,
রাত জেগে অশরীরির কথা ভাববে
না। বেশি বেশি ভাবলেই নাকি
ওরা এসে হাজির হয়। প্রথম
প্রথম বিশ্বাস হতো না এসব কথা।
কিন্তু সেদিন নিজের কানে
শুনলো ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ। নিজের
চোখেই দেখলো ভয়ঙ্কর
ড্রাকুলাটা। মনে হলো যেন মরা ব্রহ্মপুত্রের
তলা ফোঁড়ে গরম রক্ত চোষে
নিচ্ছিলো।এই এই,
কাঁপছিস কেনরে তুই? ভয় পেলি নাকি?কে কে? কে আবার, এখানে ড্রাকুলা আর মুশফিক
ছাড়া আরতো
কেউ নেই। কিন্তু কথা বললো
যে! ড্রাকুলারা মানুষের সাথে কথাও
বলে নাকি! একদম মানুষের মতো
গলা। কাঁপুনি থামলো না
মুশফিকের।আ..হা। তুই দেখি
একেবারে ভীতুর ডিম। আমি মুমিতু।মুমিতু? কোন
মুমিতু? কে মুমিতু?আমি মুমিতু রে মুমিতু। তোর
খালাতো ভাই মুমিতু। এবার
কাঁপাকাঁপি বন্ধ কর দেখি।কলজেয়
পানি ফিরে এলো মুশফিকের। তবে কাঁপুনি বন্ধ হতে
একটু সময় নিলো। তারপর এমন
ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি।
বললো ‘ওও মুমিতো…’।এতটুকু বলে থেমে যেতে পারলে
কোন ঝামেলা বাঁধতো না। কিন্তু
আগের কথার রেশ ধরে মুখ ফসকে
বলেই ফেললো ‘…
আমিতো
ভেবেছিলাম ড্রাকুলা বুঝি।’বলেছে তো সেরেছে। একেবারে জেঁকে বসলো মুমিতু- কী
সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! তুই তাহলে
অশরীরিতে বিশ্বাস করিস? তুই কি
মনে করিস সত্যি সত্যি
রক্তচোষা ড্রাকুলা আছে? তোর ধারণা ওরা
রাতের অন্ধকারে কফিনের ডালা
খুলে বেরিয়ে আসে? এমন
ধরনের গোটা দশেক প্রশ্ন করে
ফেললো এক নি:শ্বাসে। মুমিতুর
প্রশ্নের তোড়ে লজ্জায় মুখ লাল
হয়ে এলো মুশফিকের। তারপরও
আত্মপক্ষ সমর্থন করতে
ছাড়েনি- আমি কি এমনি এমনি বিশ্বাস
করি? তুই জানিস না, ওই
পোড়াবাড়িতে একটি ড্রাকুলা থাকে।কথা শুনে হেসেই কুটি কুটি মুমিতো- দেখেছিস কখনো?দেখছি না মানে! প্রায়ই ওটা গরু-ছাগলের রক্ত চোষে খায়।
রাত-বিরাতে মানুষও নিখোঁজ
হয় ওখানে। প্রায় সকালেই
পোড়োবাড়ির সামনে রক্তশূন্য
সাদা দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
রাতভর তিয়াস মিটিয়ে রক্ত পান
করে বাড়ির সামনে ফেলে রাখে
শরীর। সকালে কারো জ্ঞান ফেরে, কারো ফেরে না। আরে ধূর।
তোদের পোড়াবাড়িতে
ড্রাকুলা-ট্রাকুলা আসবে কোত্থেকে? ড্রাকুলা
তো ব্রাম স্টোকারের লেখা
একটি গা ছমছমে কাহিনী।তুই কী করে জানবি, এখানে
ড্রাকুলা আছে বা নাই। দুই দিনের
জন্য বেড়াতে এসে মুখের ওপর
চট করে বলে দিলি, এখানে
কোনো ড্রাকুলা-ট্রাকুলা নাই।
মাসুদ রানা আর তিন গোয়েন্দা পড়ে
পড়ে তোর মাথাটাই খারাপ
হয়েছে। ওসব কল্পকাহিনী কেবল বই
এর পাতায় মানায়, বাস্তবে নয়। এটা আমি ভালো করেই জানি,
তোকে শিখিয়ে দিতে হবে না।
তবে আমাদের পোড়াবাড়িতে যে
একটি ড্রাকুলা আছে, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। মহা
বিরক্ত হলো মুমিতু- এটা তোর
বিভ্রম বা মনের ভয়। এ বিষয়ে
আর কথা বলতে চাচ্ছি না। যদি
চাস তোকে দেখাতে পারি।দেখাতে পারি মানে? তুই
কি বলতে চাচ্ছিস ব্রাম স্টোকারের
ড্রাকুলার মতো এখানেও বন্দী
হয়ে আছে কোন এক পাপীর অশুভ
আত্মা? নিশুতিতে সে কফিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাদুড়ের রূপ
নিয়ে? উড়ে গিয়ে মানুষের গলার রগ ফুটিয়ে চুষে নেয় রক্ত?
তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই
আবার ঢুকে যায় কফিনে?
এতসব জানি না। এখানে
ড্রাকুলা থাকে,
এটাই সত্যি। চল এখন-ই
তোকে দেখিয়ে আনবো।
প্রস্তাবটা দিয়ে সাথে সাথেই পিছিয়ে
গেলো মুশফিক। কিন্তু ভুল
একবার করে ফেললে আর নিস্তার
নেই, অন্তত মুমিতুর হাত থেকে।এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? খালাম্মা-খালু টের পাবেন না। চল।
ওনারা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছেন।না
মানে, বলছিলাম কী…।
আমতা আমতা শুরু করলো মুশফিক।
ওও, তাহলে মানছিস যে, ওই
পোড়াবাড়িতে কোন ড্রাকুলা নেই।
থাকলে তো দেখাতে পারতি।
কথাটা তীরের মতো বিঁধলো
মুশফিকের গায়ে। ঠিক করলো
সাহস করে মুমিতুকে নিয়ে যাবে
পোড়াবাড়ির কাছে। দূর থেকে
ড্রাকুলাটিকে একবার দেখিয়েই চলে
আসবে। সাবধান থাকতে হবে, ড্রাকুলার নজরে পড়ার আগেই
ওদের ফিরে আসতে হবে। অবশ্য
ড্রাকুলার চোখ ফাঁকি দিয়ে
আসাটাও আরেক মুস্কিলের কাজ।
মহা বিপদে পড়ে গেলো সে।
কিন্তু মুমিতু ততক্ষণে চৌকাঠ
পেরিয়ে সিঁড়িতে। কী আর করা!
মুশফিককেও বেরোতে হলো।ভাগ্যিস
জোসনা রাত। কিন্তু জোসনা হলে কী হবে, কুয়াশার
মায়াবি জালে লুকোচুরি খেলছে
চাঁদের পসর। দূরের গাছ-গাছালি
দেখা যাচ্ছে তো যাচ্ছে না।
জনমানবের চিহ্ন নেই, ভর নিশিতে
থাকার কথাও নয়। একদম নিজঝুম
নিরালা। মরা ব্রহ্মপুত্র’র
কাশবন থেকে হঠাৎ হঠাৎ-ই ভেসে
আসছে শেয়ালের ডাক।
এমনিতেই ঠাণ্ডা, তার ওপর শিড়দাঁড়া বেয়ে আরেকটা ঠাণ্ডা স্রোত
বয়ে গেলো মুশফিকের। আচমকা
শোওও করে ভেসে গেলো
কনকনে বাতাস। এক মুহূর্তের
জন্য নড়ে ওঠলো পোড়াবাড়ির
সামনের গাছগুলো। ভয়ে আর
এগুতে ইচ্ছে করছে না মুশফিকের।আমরা বরং এখানেই দাঁড়াই। ড্রাকুলাটা পোড়াবাড়ি ছেড়ে
এদিকেও
আসতে পারে, তখন না হয় দেখে নেব। এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?
এখান থেকে তো ঠিকঠাকমতো
পোড়াবাড়িটাই দেখা যাচ্ছে না।
আর ওসব ড্রাকুলার ছায়-টায়া
দেখালে হবে না। আমি চাই মূর্তমান
ড্রাকুলা। চল সামনে হাঁটি।
এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াই না। তারপর
দেখা না মিললে না হয় আরো
এগোবো। আচ্ছা ঠিকআছে, এত
করে যেহেতু বলছিস কিছুক্ষণ
না হয় অপেক্ষা করলাম। তবে শর্ত
আছে একটা।কী শর্ত?ব্রাম স্টোকারের লেখা ড্রাকুলার কাহিনীটা আমি বলব, আর তোকে
এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে
হবে।এতো একেবারে মরার ওপর খরার ঘা। বিপদের পর বিপদ এসে
পড়ছে মুশফিকের ঘাড়ে। এখন কী
করা উচিত তার,
সামনে
এগুবে, নাকি এখানে দাঁড়িয়ে ড্রাকুলার কাহিনী শুনবে? একটাও
ওর পছন্দের অপশন নয়। তবুও
কেবল আত্মসম্মানের খাতিরে
প্রচণ্ড বিরক্তি আর অনিচ্ছা
নিয়ে কাহিনী শুনবে বলেই ঠিক করলো
মুশফিক।তাহলে শোন, ব্রাম স্টোকার ছিলেন আয়ারল্যান্ডের এক লেখক।
তিনিই ‘ড্রাকুলা’ নামের উপন্যাসটি লিখেন। আর
এটি প্রকাশ হয়
১৮৯৭ সালে। ড্রাকুলা উপন্যাসের
রহস্য চরিত্রের নাম কাউন্ট
ড্রাকুলা। ইংরেজি ভাষায়
স্টোকারের সেই ড্রাকুলা উপন্যাসটি
ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। এ
কারণেই অনুবাদ হয় অনেকগুলো
ভাষায়। আর তোদের মতো ভীতুর
ডিমরা এগুলো পড়ে পড়ে
মনের মাঝে গেঁথে নিয়েছে, সত্যি সত্যিই ড্রাকুলার অস্তিত্ব আছে।ক্ষেপে গেলো মুশফিক।
ওর ভয়টা একটু বেশি, তাই বলে কথায়
কথায় কেউ ভীতুর ডিম বলে খোটা
দেবে এমনটা মানতে রাজি
নয়- সাবধান মুমিতু, আরেকবার যদি আমাকে ভীতুর ডিম বলেছিস
তো …তো কী করবি, তোর
ওই ড্রাকুলাকে দিয়ে আমার রক্ত খাওয়াবি?
বিশ্রীভাবে হাসলো মুমিতু।
জবাবে কিছু একটা করতে চাইলেও
আপাতত চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের
কাজ মনে করলো মুশফিক।
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা এবং কী
ভেবে যেন আবার ব্রাম
স্টোকারের ড্রাকুলা কথন শুরু
করলো মুমিতু- তারপর শোন,
ড্রাকুলা ছিলো অস্ট্রিয়ার
ট্রানসালভানিয়ার এক রক্তচোষা। দিনের
বেলা মানুষের মতোই থাকতো, লোকজনের সাথে ভদ্র ব্যবহার
করতো। আর রাত হলেই অস্থির
হয়ে যেতো রক্তের নেশায়।তার ছিলো অঢেল সম্পত্তি। আর বিশাল এক দুর্গ। দুর্গের ভেতর
কফিনে বন্দি ছিলো আরো অশুভ
আত্মা। ছিলো ড্রাকুলার কয়েকটি
বউ। উপন্যাসের কাহিনী শুরু
হয়েছে এক ইংরেজ আইনজীবীকে
দিয়ে। তার নাম জোনাথন
হার্কার। তিনি আইন বিষয়ে পড়ালেখা
শেষ করে যে কোম্পানিতে চাকরি
পান সে কোম্পানির একটি
কাজেই তাকে যেতে হয়েছিলো
ড্রাকুলার দুর্গে। তার কাজ ছিলো
কাউন্ট ড্রাকুলা নামের ওই
লোককে আইনি সহায়তা দেয়া। বেচারা
হার্কার কী আর তখন জানতো যে
ড্রাকুলা লোকটা এত ভয়ঙ্কর!তাহলে পরে কিভাবে জানতে পারলো? প্রশ্ন করলো মুশফিক।কথার মাঝে কথা বলবি না। সেটাইতো বলছি-
ড্রাকুলা তাকে
নিষেধ করেছিলো রাতের বেলা
যেন বেডরুমের বাইরে বের না
হয়। কিন্তু বেচারা হার্কারের
প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো
ড্রাকুলাকে। তার রাজকীয়
চালচলন, রহস্যময় আচরণ আর
নিশুতির কিছু বীভৎস দৃশ্য
হার্কারের নজরে আসে। তাই এক
রাতে ঠিক করলো, দুর্গটা ঘুরেফিরে দেখবে। ব্যস, যেই ভাবা সেই
কাজ। আর যা হওয়ার হলোও তাই।কী
হলো? থিরথির করে কাঁপছে মুশফিক। তবে এ কাঁপুনি ভয়ে
নাকি শীতের প্রকোপে তা
অনুমান করা কঠিন। কী আর হবে,
পড়লো রক্তচোষা বাদুড়দের
খপ্পরে। এখানে আবার বাদুড় এলো
কোত্থেকে?আরে বোকা কোথাকার, ভ্যাম্পায়ারের
নাম শুনিসনি?
ওরা বাদুড়,
তবে রক্ত পান করে।
ড্রাকুলাওতো রক্ত পান করতো, ওড়তে
পারতো। তাই তাকেও রক্তচোষা
বাদুড় অর্থাৎ ভ্যাম্পায়ার বলা যায়,
নাকি? হার্কার সেদিন তিনটি স্ত্রী ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে পড়লো। এরা
ছিলো ড্রাকুলার বউ। শেষ
মুহূর্তে কাউন্ট ড্রাকুলা তাকে রক্ষা করে।
রক্ষা করলো বলে ভাববি না
হার্কারকে সে সত্যি সত্যিই বাঁচাতে
চাইতো। আসলে প্রয়োজনীয় আইনি
সাহায্য নেয়ার আগে সে
হার্কারকে মারতে চাইছিলো না।
শুধু তাই নয়,
ড্রাকুলার ইচ্ছে
ছিলো লন্ডনের লক্ষ্য মানুষের
মাঝে এসে উপস্থিত হওয়া। এখানে
আসতে পারলে তার বীভৎস
কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি আরো বাড়বে।
কিন্তু ইংল্যন্ড ও লন্ডন
সম্পর্কে ড্রাকুলার কোন জ্ঞান ছিলো না। এ
বিষয়ে সে হার্কারের কাছ থেকে
পাঠ নিতে থাকলো।হার্কার এই পিশাচটাকে শেখাতে গেল কেন?প্রাণের ভয় আছে না? প্রাণের
ভয়ে শেখালো। কিন্তু সে
ভালোভাবেই বুঝেছিলো যে, এখানে সে বন্দি হয়ে আছে। তাই
কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ থেকে
পালিয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির করতে
লাগলো সে। একদিন সুযোগ বুঝে
পালিয়েও গেল। কিন্তু ততদিনে
লন্ডন সম্পর্কে যা জানার তা
জেনে গেছে ড্রাকুলা।তারপর কী হলো, ড্রাকুলা কি লন্ডনে গিয়ে
হার্কারকে ধরে
ফেললো?এত সহজেই ধরে ফেলবে! তখন থেকেই শুরু হলো আসল খেলা।
এর কিছুদিন পরই একটি রাশিয়ান
জাহাজে ঘটে রহস্যময় ঘটনা।
জাহাজটি ইংল্যান্ডের উদ্দেশে
রওনা হয়েছিলো। অজ্ঞাত কারণে এর
সব নাবিক নিখোঁজ হয়ে যায়।
শুধুমাত্র ক্যাপ্টেনের লাশ পাওয়া
যায় হালের সাথে বাঁধা
অবস্থায়। ক্যাপ্টেনের ডাইরি পড়ে জানা
যায়, এখানে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তারপর থেকেই
জাহাজের মাঝিমাল্লারা একে
একে নিখোঁজ হতে থাকে। জাহাজ
থেকে কুকুরের মতো একটি
জানোয়ারকে লাফিয়ে সাগরতীরে
নেমে যেতেও দেখেছিল
ক্যাপ্টেন। আর জাহাজের মালের তালিকায়
ছিল ট্রানসিলভানিয়া থেকে আসা
রুপালি বালি ও গুঁড়ো মাটি।এর মানে ট্রানসিলভানিয়া থেকে কাউন্ট ড্রাকুলা কুকুর সেজে
জাহাজে ওঠেছিল? প্রশ্ন করলো মুশফিক হ্যাঁ। তুই তো দেখছি
ভালো বুদ্ধিমান হয়ে ওঠছিস।আর
ওই কুকুরটাই যাত্রীদের রক্ত পান করার পর লাশ নিখোঁজ
করে দিতো, তাই না?হ্যাঁ, তাই। তারপরের ঘটনাগুলো আরো লোমহর্ষক। লন্ডনে গিয়ে
ড্রাকুলা সন্ধান পায়
হার্কারের স্ত্রী উইলহেমিনা মুরে ও তার বান্ধবী
লুসি ওয়েস্টেনবারের।
ঘটনাচক্রে সেখানে গিয়ে কাউন্ট ড্রাকুলা
তার একজন বিশেষ অনুচরও যোগাড়
করে ফেলে। লন্ডন হয়ে
ওঠে ড্রাকুলার রক্ত পানের
স্বর্গরাজ্য। সে তার রক্তপানের সুবিধার
জন্য লন্ডন চিড়িয়াখানা থেকে
একটি নেকড়ে ছেড়ে দেয়। নেকড়ের
আক্রমণের ভয়ে মারা যায় লুসির
মা এবং এর কিছুদিন পর
লুসিও।হার্কারের স্ত্রী
মিনার কী অবস্থা হয়?মিনার অবস্থার কথা বলার আগে
লুসির কথা বলে নিই। লুসিকে
কবর দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন
পরই পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়
প্রায়ই নাকি একটি সুন্দরী
নারী ছোট ছেলেমেয়েদের পিছু নিচ্ছে।
সেই সুন্দরী নারী ছিলো মূলত
লুসির আত্মা। সে মরে গিয়ে
ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছিলো।
একসময় হৃৎপিণ্ডে শূলবিদ্ধ করে
তাকে মেরে ফেলা হয়। তখন সবাই
ড্রাকুলার বিরুদ্ধে সোচ্চার
হয়ে যায়। কিভাবে এই পিশাচটাকে
হত্যা করা যায়,
সে চিন্তাই
সবার মাথায়। এর কিছুদিন পর
ড্রাকুলা হার্কারের স্ত্রী মিনার ওপর
প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।
কৌশলে ড্রাকুলা মিনাকে নিজের
(ড্রাকুলা) রক্ত পান করায়। তারপর ড্রাকুলা আর মিনার মাঝে
সৃস্টি হয় এক অতিলৌকিক
বন্ধন। মিনার মানসিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ
চলে যায় ড্রাকুলার হাতে।
ড্রাকুলার কারসাজিতে প্রায়ই অজ্ঞান
হয়ে যেত মিনা। তখন ড্রাকুলার
সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ
থাকতো ওর। আর এই সুযোগটি
কাজে লাগানোর চেস্টা করলো
হার্কারসহ ড্রাকুলাবিরোধিরা।
মিনার অজ্ঞান অবস্থায় তারা ড্রাকুলার
গতিবিধি বুঝার চেস্টা করতো।
এমনকি মাঝে মাঝে সজ্ঞান
অবস্থায়ও মিনাকে সম্মোহিত
করে ড্রাকুলা কোথায় আছে তা জেনে
নিতো।কিভাবে সম্ভব?কিভাবে সম্ভব, আমি
কী করে বলবো?
ব্রাম স্টোকারকে গিয়ে
জিজ্ঞেস কর। আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো।
আপাতত তুই বাকিটা বল দিলিতো
মাঝখান থেকে মেজাজ খারাপ
করে। বাকিটা আর কী বলবো, তারপর ঘটনাচক্রে কাউন্ট ড্রাকুলা
আবার ফেরত যায় তার
ট্রানসিলভানিয়ার দুর্গে। ড্রাকুলার পিছু
ধাওয়া করে হার্কারের দল।
সবশেষে কোন এক সূর্যাস্তের আগে
ছুরি দিয়ে গলা কেটে ও
হৃৎপিণ্ডে শূলবিদ্ধ করে ড্রাকুলাকে ধ্বংস
করে তারা।মিনার কি অবস্থা হয়?মিনার আর কী অবস্থা হবে! তার ওপর থেকে ড্রাকুলার প্রভাব
কেটে যায়। আর হার্কার ও মিনা
সুখে শান্তিতে সংসার করতে
থাকে।এত দ্রুত বলে শেষ করে
দিলি?দ্রুতই তো বলবো। লোমহর্ষক ঘটনাগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে বললে,
তুই এখানেই হার্টফেল করতি।‘হার্টফেল’ শব্দটা শুনে সত্যিই হার্টফেল
করার অবস্থা হলো
মুশফিকের। ব্রাম স্টোকারের
ড্রাকুলার ঘোর কাটিয়ে ততক্ষণে সে
ফিরে এসেছে পোড়াবাড়ির
ড্রাকুলায়। কাহিনীর জালে আটকা পড়ে
কখন যে ওরা এগিয়ে এসেছে
পোড়াবাড়ির কাছাকাছি টেরই
পায়নি। মাথায় সঙ্কেত বেজে
ওঠলো, এখন দুপুর রাত। আর ওরা
দাঁড়িয়ে আছে পোড়াবাড়ির ঠিক
সামনে। ব্রহ্মপুত্র’র তীরেই পুরনো
রাজবাড়ি এটি। কেউ থাকে না।
সামনের দিকে ছোটবড়
অনেকগুলো ফটক। সবগুলো সিল
করা। প্রধান ফটকের বাম
দিকে আট-দশটি ঘোড়ার মূর্তি, সামনের দু’পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
আছে। যেন এখনি চিঁহি স্বরে
ছুটবে। ডান দিকে কয়েকটি
জঙ্গলশিঙে হরিণের মূর্তি, তাকিয়ে আছে ঠিক ওদের দিকে। এখন
আর কোন ওপায় নেই। আজ নির্ঘাত
ড্রাকুলার কবলে পড়তে
হবে। তারপর রক্তশূন্য
অবস্থায় সাদা হয়ে পড়ে থাকতে হবে
এখানে। এ ভাবনা যে কেবল
মুশফিকের, এমন নয়। মুমিতুও
ভীষণ ভড়কে গেছে। পোড়াবাড়িতে
আসার পর মনে হচ্ছে ঠিকই
এর ভেতর একটি ড্রাকুলা আছে।
এই প্রথমবারের মতো মুমিতুর
মনে হলো ড্রাকুলার অস্তিত্ব
রয়েছে। অনেকেতো বলাবলি করে ব্রাম
স্টোকারের ড্রাকুলার কাহিনী
লেখা হয়েছে সত্যিকার এক মানুষের
রহস্যময় জীবন থেকে। ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি লেখার আগে স্টোকার
সাত বছর ইউরিপীয় লোককথা ও
ভ্যাম্পায়ার মানবদের ওপর
পড়াশোনা করেছিলেন। ইউরোপের
স্লাভ জাতির লোকেরা বিশ্বাস
করে, পাপী ও শয়তান লোকদের আত্মা রক্তচোষার রূপ ধরে
পৃথিবীতে ফিরে আসে।মুশফিকের
চেয়ে বেশি কাঁপছে মুমিতু। দু’জন জড়াজড়ি করে
হাঁটছে। কিন্তু কোনদিকে
হাঁটছে?কে জানে? এই মুহূর্তে কোন দিক জ্ঞান
তাদের নেই। আর নেই
ভাষাজ্ঞানও। মুমিতুর মুখ
দিয়ে বেরিয়ে আসছে আবোলতাবোল
ধরনের কিছু শব্দ ‘ভোলাদ! ভোলাদ! আমাদের এবারের মতো
ছেড়ে দাও।’আপাত বিবেচনায় আবোলতাবোল মনে হলেও শব্দগুলো একেবারে
আবোলতাবোল নয়। কারণ অনেকের
ধারণা ভোলাদ নামের এক
ব্যক্তির কাহিনী থেকেই
স্টোকার ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন।
ভোলাদের জন্ম ১৪৩২ সালে
পাহাড়ি অঞ্চল ট্রানসিলভানিয়াতেই।
তার বাবা ছিল ওয়ালাচিয়ার
শাসক। সেটা এখন রুমানিয়াতে।
শত্রুর হাতে ভোলাদের বাবা
মারা যায়। যুবক ভোলাদ সিংহাসনে
বসেই প্রতিশোধ নেয়া শুরু
করে। অনেক তুর্কিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা
করতে থাকে। মানুষ হত্যা করার
নানা ধরনের বীভৎস পদ্ধতি সে
আবিষ্কার করেছিল, তাই তাকে বলা হতো যমদূত। তীক্ষ্ম অস্ত্র দিয়ে
সে মানুষকে এফোঁড়-ওফোঁড়
ছিঁড়ে ফেলতো। ১৪৭৬ সালে ভোলাদ
শত্রুর হাতে মারা যায়।
কয়েকবছর পর তার কবর খুঁড়ে দেখা
যায়, কবরে লাশ নেই। তাই লোকজনের ধারণা পরবর্তীতে
ভোলাদের অশুভ আত্মা
ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়। আর এ কাহিনীটিই
উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’র উৎস বলে অনেকে মনে করে।তখনো
‘ভোলাদ’ শব্দটি মুশফিকের কাছে
দুর্বোধ্য। ওর ধারণা
মুমিতু হয়তো পাগল হয়ে গেছে।
অবশ্য নিজেকেও কেমন পাগল
পাগল লাগছে। এমন কঠিন
পরিস্থিতিতে পাগল পাগল লাগাটাই
স্বাভাবিক। কোনদিকে হাঁটছে, কোথায় ঠেকছে কিছুই বলতে পারছে
না। কিন্তু দু’জন একসাথেই আছে। আর প্রতিমূহূর্তে অপেক্ষা
করছে এই বুঝি রক্তচোষাটা
কাঁধে বসিয়ে দিলো তীক্ষ্ম দাঁত। কিন্তু
না, দাঁতও বসাচ্ছে না, আবার
ঘোর থেকেও দিচ্ছে না মুক্তি।
আটকে গেছে মায়াজালে। পুরো
পৃথিবীকে দোলে উঠতে দেখলো
ওরা। দুলে ওঠলো কাশবন, পোড়াবাড়ির প্রধান ফটক। আবার
ভেসে এলো সেই কনকনে ভয়ঙ্কর
বাতাস। কয়েকটি তেঁতুলগাছ
একসাথে কুর্নিশ করলো
পোড়াবাড়িটাকে। এখনি ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসবে রক্তচোষা
ড্রাকুলা।