ভূতুড়ে কাহিনী ৯২: কি বলবেন ‘তাঁরা' নেই?

 দু'মাস আগে এক সকালে সল্টলেক থেকে ফোনটি পেয়েছিলেন শান্তনু সেন৷

 

 

ফোনের ওপার থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় জানানো হয়েছিল, তাঁদের বাড়ির বাথরুমে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে৷ বাথরুমের আয়নার দিকে তাকালেই নিজের মুখের বদলে ভেসে উঠছে এক অশরীরী আবছায়া মুখ৷ বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আকৃতির৷ কিছু একটা যেন বলতেও চাইছে৷ কিন্তু কী সেটা বোঝা যাচ্ছে না৷

 

 

শান্তনুবাবু প্যারানরমাল সোসাইটি, কলকাতা চ্যাপ্টারের প্রতিষ্ঠাতা৷ সর্বভারতীয় এই সোসাইটির কাজ ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মা-অপ্রাকৃত বিষয় বা ঘটনা নিয়ে গবেষণা করা৷ গত তিন বছর ধরে এই শহর ও আশপাশের এলাকায় ভূত-প্রেত-অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন নিবিষ্টভাবে৷ তাঁর কাজের দৌলতেই পূর্ব ভারতজুড়ে ভূত-বিজ্ঞানী হিসাবে শান্তনুবাবুর নামও ছড়িয়েছে বিস্তর!

 

 

ফোন পেয়ে জটিল সব যন্ত্রপাতি-সহ সল্টলেকের ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির সোসাইটির ভূত বিজ্ঞানীরা৷ যন্ত্রপাতি মানে মূলত থার্মোমিটার, ভিডিও রেকর্ডার, সিসিটিভি৷ আর কে-২ মিটার৷ মার্কিন মুলুকে তৈরি যে মহার্ঘ্য যন্ত্রে অদৃশ্য ‘অপ্রাকৃত' শক্তির উপস্থিতি জানা যায়৷ এককথায়, ভূতের সঙ্গে যোগাযোগ করার, কথা বলার মেশিন৷ ওয়াকিটকির মতো যে যন্ত্রের মাথার দিকে চারটি ছোট বাল্ব৷ অশরীরী শক্তির উপস্থিতি মিললে সেগুলি জ্বলে ওঠে দপদপ করে৷

 

 

পরীক্ষার শুরুতেই গোটা বাড়ির মেন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ যাতে বাড়িতে কোনওরকম তড়িত্চুম্বকীয় ক্ষেত্র না থাকে৷ এর পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য সেই এনার্জিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সে আদৌ ওখানে আছে কি না৷ থাকলে কে-চ মিটারের দু'টি আলো জ্বালিয়ে দেখাক৷ যেই কথা, তেমন কাজ৷ দপ করে জ্বলে ওঠে মিটারের দু'টি বাল্ব৷ ‘অপ্রাকৃত শক্তি'-র উপস্হিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন সে ওখানে আছে? তার কি কিছু বলার আছে? থাকলে চারটি বাল্ব জ্বালাক সে৷ আবারও জ্বলে ওঠে বাল্ব৷ 

 

 

সব দেখে নিশ্চিত হয়ে সেদিন বাড়ির মালিককে আয়নাটি বদলানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন ভূত-বিজ্ঞানীরা৷ শান্তনুবাবুর কথায়, বাথরুমের স্বল্প পরিসরে ওই আয়নাটি ছিল এনার্জির বাহক৷ মেন সুইচ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তাই সেখানে মানবদেহের ছায়া পড়তেই আয়নার কাচে হাই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড (ইএমএফ) তৈরি হয়৷ তাতেই জ্বলেছিল বাল্ব৷

 

 

সোসাইটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৌমেন কোটাল ওড়িশার একটি ঘটনা বলছেন৷ ভুবনেশ্বরের কাছে একটি ধূপ তৈরির কারখানায় বেশ কিছুদিন ধরে উপদ্রব চলছিল৷ শ্রমিকদের জিনিস নির্দিষ্ট স্থানে থাকত না৷ ফিসফিস করে কে যেন কথা বলত৷ একা কেউ কোথাও থাকলে হঠাত্‍ অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিত৷ জনশ্রূতি ছিল, কারখানাটি তৈরি হওয়ার আগে ওই জায়গায় একটি ডোবা ছিল৷ খুন করে না কি সেখানে দেহ ফেলে দেওয়া হত৷ শুনে ভূত-বিজ্ঞানীদের দল রওনা দেয় ওড়িশা৷ পরীক্ষা শুরু হয়৷ সেই কারখানার বিদ্যুতের মেন সুইচ বন্ধ করে একই পতি৷ জিজ্ঞাসা করা হয়, কেউ থাকলে দু'টি বাল্ব জ্বালিয়ে দেখাক৷ ইতিবাচক উত্তর মেলে৷ পুরুষ হলে চারটি বাল্ব জ্বালাতে বলা হয়৷ তত্ক্ষণাত্‍ জ্বলে ওঠে আলো৷ সব দেখে বিশেষজ্ঞদের নিদান, "হ্যাঁ! এখানে কিছু একটা আছে৷ তবে ভয়ের কিছু নেই৷ ওই ‘শক্তি' ক্ষতিকর নয়৷" ভূতের উত্পাতের অভিযোগ এসেছিল কার্শিয়াংয়ের ডাউহিল রোড থেকেও৷ তবে পরীক্ষায় কে-২ মিটারে সেখানে ভূতের উপস্হিতি মেলেনি৷

 

 

তবে ‘ভূত' শব্দটায় তীব্র আপত্তি কলকাতার প্যারানরমাল সোসাইটির৷ তাঁরা বলেন ‘এনার্জি'৷ মৃত্যুর পর মানবদেহের বাইরে বেরিয়ে আসা শক্তি৷ অদৃশ্য কিন্তু ভীষণরকম বাস্তব৷ প্যারানরমাল সোসাইটির কথায়, "প্রতি মানবদেহেই একটা ‘এনার্জি' বা ‘শক্তি' আছে৷ প্রাণশক্তি৷ মৃত্যুর পর সেই ‘শক্তি' তো নষ্ট হয় না৷ বিজ্ঞানই বলছে শক্তি রূপান্তরিত হয়৷ মানবদেহের সংস্পর্শে থাকতে চায় সেই এনার্জি৷" তবে তা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে কোথায়? ভূতবিশেষজ্ঞরা বলছেন, "এনার্জি হাওয়ায় মিশে থাকে৷ এমনকী কখনও তাদের আশ্রয়স্থলও থাকে৷ সল্টলেকের ওই বাথরুম বা ভুবনেশ্বরের কারখানা ছিল তাদের সেই আশ্রয়স্থল৷"

 

 

বিশেষজ্ঞরা জানাচেছন, এই ধরনের এনার্জি ভীষণ দুর্বল হয়৷ প্রতিক্রিয়া দিতে চাইলে আশপাশ থেকে আরও অনেক শক্তি তাকে সংগ্রহ করতে হয়৷ সেই জায়গায় তখন হাই ‘ইএমএফ' তৈরি হয়৷ আশপাশে তাপমাত্রা হু হু করে নামতে থাকে৷ শান্তনুবাবু জানাচ্ছেন, "অল্প পরিসরে বৈদ্যুতিক তার থাকলে, এনার্জির উপস্থিতি সম্ভব৷ সেই অবস্হায় কোনও মানবদেহ কাছাকাছি এলে তাঁর মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক ব্যবহার করে৷ কারণ মস্তিষ্ক সেই এনার্জির চরিত্র ‘রিড' করতে পারে না৷ এটা আসলে ‘হ্যালুসিনেশন'৷" শান্তনুবাবুর পরামর্শ, "এমন কিছু হলে, বিষয়টাকে এনজয় করুন৷ ওটা একটা এনার্জি মাত্র৷ খুব বেশি হলে আপনার ঘরের আলোগুলো একটু নিভু নিভু হবে৷ তারা একেবারেই ক্ষতিকর নয়৷"তা হলে এই একবিংশ শতাব্দীতে ‘ভূত' বলে আদৌ কি কিছু আছে? অশরীরী আত্মা? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গবেষক দেবাশিস মজুমদারের কথায়, "হয়তো কিছুটা সত্যি৷ কিছুটা অতিরঞ্জিত৷ তবে সত্যি বা মিথ্যা, বা এনার্জি যা-ই হোক, বিশ্বাসের চক্করে পড়ে অনেক তথ্য সামনে আসে৷ জানা যায় ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর নানা অজানা ইতিহাস৷"আজ ভূতচতুর্দশী! কার্তিক অমাবস্যার এই প্রাক সন্ধ্যায় নাকি অশরীরী আত্মারা নেমে আসে ধরাধামে৷ যাঁরা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন৷মৃত সেই পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে এই রাতে বাতি জ্বালান উত্তর প্রজন্ম৷ আকাশপ্রদীপ! গোটা কার্তিকমাস জুড়ে৷তার পরও কি বলবেন ‘তাঁরা' নেই? ভাল করে দেখুন তো! আশপাশে ঠাওর করে৷