আমাদের এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু ভৌতিক ঘটনা

 

ভূত-প্রেতের ভয় কোনোদিনই ছিলনা, এইরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া

ভার। পূর্নিমা অথবা অমাবশ্যার রাতে হাট-বাজার থেকে ফিরতে

গিয়ে ভূত দেখে মরে গেছে, এইরকম ঘটনা আমরা সবাইই

কম-বেশি শুনি। ছোটবেলায় আমার ভূত-প্রেত বিষয়ে ব্যাপক

আগ্রহ ছিল। আমি ছোটবেলায় সবচে বেশি ভূতের গল্প শুনেছি

আমার বাবা আর দাদীর মুখে। এছাড়াও অনেকের মুখেই শুনেছি।

তখন আমি এসকল গল্প শুনে কখনো অবিশ্বাস করিনি। সবকিছুই

সত্য ভেবেছি। আমার অন্যান্য পরিচিতদের কাছেও শুনেছি অনেক

ঘটনার বিবরন। সেইসব ঘটনারই কিছুটা বলবো। যার একটা

ঘটনা ছাড়া, বাকী সবগুলো ঘটনাই আমাদের এলাকায় ঘটে গেছে।

 রাত প্রায় দুইটা। আকাশে মেঘেদের ডাকাডাকি। মাঝে মাঝে

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ চমকায়, তখন চারিদিক কিছুক্ষণের

জন্য আলোকিত হয়ে যায়। মদন শিকদার কোনো এক কারনে

দূরে কোথাও গিয়েছিলেন। তাই ফিরতে এত রাত হলো। আমাদের

বাড়ির সামনের রাস্তাটা যেখানে মোড় নিয়েছে, তার পাশেই একটা

লম্বা তালগাছ। জায়গার নাম, মোল্লা বাড়ির মোড়। বাশ ঝার,

তালগাছ, হিজিবিজি অবস্থায় থাকা মেহেগুনি গাছ আর আমগাছ

দিয়ে ঘেরা জায়গাটা একসময় দিনের বেলাতেই ভয়ানক লাগতো।

মদন শিকদার মোল্লা বাড়ির মোড়ে এসে হঠাত থমকে দাঁড়ালেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বুঝতে পারলেন, সামনের

তালগাছটা কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। কিছু একটা বুঝতে

পেরে তিনি গাছের মাথার দিকে তাকালেন না। আবারো বাড়ির

দিকে পা বাড়ালে তালগাছটা প্রবল ভাবে কাঁপা শুরু করে। হঠাত

মদন শিকদারের ওপর কে যেন প্রসাব করে দেয়। উটকো গন্ধযুক্ত

প্রসাবে মদন শিকদারের শরীর ভিজে যায়। মদন শিকদার আর

কালবিলম্ব না করে এক দৌড়ে বাড়িতে এসে পরে। বাড়িতে

আসার পর লক্ষ্য করে, তাঁর শরীর পুরোটাই শুকনো। একটুও

ভেজা নয়। এইধরনের ঘটনা সেই মোল্লা বাড়ির মোড়ে মাঝে মাঝেই ঘটতো।

মোল্লা বাড়ির সেই মোড় থেকে একটু আগে, রাস্তার বাম পাশে

একটা বড় আমগাছ ছিলো। ইয়া বড় বড় আম ধরতো সেই গাছে।

আষাঢ় মাসের ঝরে যখন আম কুড়াতে যেতাম সেই আমতলায়,

তখন মাঝে মাঝে বড় বড় আম মাথায় পড়ে অনেকে অজ্ঞান হয়ে

যেত। একদিন স্কুল ছুটি দিয়েছে আমার। আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি।

হাতে একটা কঞ্চি নিয়ে খেলতে খেলতে বাড়িতে ফিরছি। এমন

সময় পরিচিত কোনো তরুণীর চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম সেই

আমগাছটার দিকে। গিয়ে দেখি সেই বড় আপু, চোখ বড় বড় করে

এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। যেহেতু তিনি চিৎকার দেয়ার পর আমিই

প্রথম ওখানে গিয়েছি, তাই তিনি আমাকে লক্ষ্য করে হাতের

ইশারায় গাছের ডালার দিকে তাকাতে বললেন। আমি গাছের দিকে

তাকালাম। এবং তাকিয়ে যা দেখলাম, তা আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত

মনে থাকবে। দেখলাম, গাছে একটা মেয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে

আছে। মাথাটা একটু বেঁকে আছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে।

এতক্ষণে আরও মানুষ এসে গেছে। আমি ততক্ষণে প্রায় অজ্ঞান

হয়ে গেছি। আসলে ওই বয়সে আমার জন্য ঘটনাটা খুবই ভয়ঙ্কর

ছিলো। ঐদিন সারাদিন লাশটা গাছে ঝুলে ছিলো। কেও নামায়নি।

দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ঝুলে থাকা লাশ দেখার জন্য এসেছিলো

সেদিন। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। আসল ঘটনা হচ্ছে, সেই মেয়ের মৃত্যুর পর শুরু হয় মানুষের নানা

রকম ভয়ভীতির। এলাকার অনেকেই দেখতে থাকে, অনেক রাতে

সেই মরে যাওয়া মেয়েটি সেই গাছের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে।

রাস্তা দিয়ে কেও হেটে গেলে, হাত ইশারায় ডাকে। তার কয়েকদিন

পর, এলাকার মুরুব্বীদের উদ্যোগে গাছটা কেটে ফেলা হয়। আমার এক বন্ধু রাজীব। আমাদের এলাকারই ছেলে। ও আর ওর

সমবয়সী মামা সবুজ, একদিন রাতে যাচ্ছিলো ওর খালার বাড়ি।

ওর খালার বাড়ি যেতে হলে, সেই মোল্লা বাড়ির মোড় দিয়ে যেতে

হয়। সবুজের হাতে টর্চ লাইট। মামা-ভাগ্নে গল্প করতে করতে

আসছে। এমন সময় ওরা দেখলো, সামনে থেকে কিছু একটা

ওদের দিকে ধীর পায়ে হেটে আসছে। মুখ দিয়ে হালকা গোঙানির

শব্দ। ওরা ভাবলো, হয়তো পাগল-টাগল কিছু একটা হবে। ওরাও

সামনের দিকে এগিয়ে চললো। সেই জিনিসটা যখন ওদের পাশ

দিয়ে গেল, তখন মনে হলো যেন, কাঁচা মাছের গন্ধে চারিদিক

ছেয়ে গেছে। সবুজ একটু সাহস করে যখন পাশে ফিরে তাকালো,

তখন দেখা গেল একটা জ্যান্ত মাছ চিবুচ্ছে। দুইঞ্চি সমান দাঁত

আর মাছটাকে ছাড়া ওরা আর কিছুই দেখতে পেলনা। ওরা ভয়

পেয়ে গেল। আর কালবিলম্ব না করে, সোজা হাটা দিলো। রাজীবের বাবা তখন বয়সে যুবক। বন্ধুরা মিলে একদিন প্ল্যান

করলো, ছাগল চুরি করা হবে। প্ল্যান মোতাবেক একটা ছাগল চুরি

করা হলো। আমাদের এলাকার পাশেই বিশাল বড় একটা বিল

আছে। নাম- কোঠাবাড়ি। কোঠাবাড়ির প্রায় মাঝখানে একটা ভিটা

আছে। শত বছর ধরে কেও থাকেনা সেই ভিটায়। তবে লোকমুখে

আমরা শুনেছি, অনেক আগে নাকি এখানে এক বুড়ি থাকতো।

তাই সেই ভিটার নাম হয়েছে বুড়ির ভিটা। বুড়ির ভিটা পুরোটাই

জঙ্গল আর বড় বড় গাছ-গাছালি দিয়ে ভরা। দিনের বেলায়ও কেও

যায়না ওখানে। রাজীবের বাবা আর তাঁর বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো,

যেহেতু ওখানে কেও যায়না কখনো, তাই ঐ জায়গাটাই ছাগল

জবাই করে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হবে। ওখানেই ছাগলটাকে

জবাই করে খাওয়া হবে। অনেক রাতে তাঁরা ছাগলটাকে নিয়ে

হাজির হলো সেই বুড়ির ভিটায়। ছাগল জবাই করলে ছাগলের রক্ত

যেন এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না যায়, তাই একটা গর্ত করা

হলো। ছাগলটার গলা সেই গর্তের ওপর রেখে তাঁরা ছাগলটাকে

জবাই করা শুরু করলো। এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, সেই

গর্তের ওপর একটা হাতের ছায়া এসে পড়েছে। রক্ত গর্তে না

পড়ে, সেই হাতের ছায়াটার ওপর গিয়ে পড়ছে। এবং রক্ত শুষে

খাওয়ার মতো আওয়াজ করে কেও রক্ত শুষে খাচ্ছে। এলাকারই দুই ভাই। রাতের বেলা কোঠাবাড়ির বিল ধরে

আসছিলো। বুড়ির ভিটার কাছাকাছি এসে দেখে, বুড়ির ভিটায়

কারও জানাযা নামাজ পড়ানো হচ্ছে। তারাও জানাযা নামাজে

শরীক হলো। নামাজের পর সেই বুড়ির ভিটাতেই লাশ দাফন করা

হলো। তারাও লাশ দাফনে সহযোগিতা করলো। তারপর বাড়িতে

এসে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবার কাছে

জানতে চাইলো, এলাকার কে মরেছে? সবাই বললো, কই! কেউ

তো মরেনি। তাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাহলে গত রাতে তাঁরা

কার জানাযা পড়লো? কাকে দাফন করলো? ছুটে গেলেন বুড়ির

ভিটায় লোকজন নিয়ে। গিয়ে দেখা গেল, কোনো কবর নেই

সেখানে। এলাকার এক হুজুরের কাহিনী। ষে যখন মাদ্রাসায় পড়তো, তখন

তাদের এক শিক্ষক তাদেরকে খালি জীনের গল্প বলতো। তাদের

সেই শিক্ষকের সাথে নাকি জীনদের ভালো সম্পর্ক। তাঁরা সেই

শিক্ষকের কথাকে গাজাখুরি গল্প ভেবে উড়িয়ে দিতেন। তো সেই

শিক্ষক একদিন তাদেরকে প্রমাণ দেখাতে নিয়ে গেলেন মাদ্রাসার

পেছনের কোনো জনমানবহীন জায়গায়। গভীর রাতে। অনেক্ষণ

অপেক্ষা করার পর তাঁরা সবাই জীন দেখতে পেলেন। আকাশে

উড়ে যাচ্ছে। তাদেরকে দেখে এক ব্যাগ মিষ্টি ফেললো জীনেরা।

তাঁরা সবাই নাকি সেই মিষ্টি খেয়েছিলো। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই

কিছু অতি পুংটা পোলাপান থাকে। তাদের মাদ্রাসাতেও ছিলো।

তিনিও সেই পুংটাদের দলেই ছিলেন। তো তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন,

তাঁরা কয়েকজন মিলে আবারও সেই জায়গায় যাবেন, গভীর

রাতে। তারপর দেখবেন, সত্যি সত্যিই জীনেরা সেখানে উড়ে কি

না! অনেক রাতে তাঁরা অবস্থান নিলেন সেই জায়গায়। হালকা

বাতাস বইছে। মশাদের উপদ্রপ প্রকট। আকাশে কিছু কিছু তারা

দেখা যাচ্ছে। এমন সময় হঠাত দেখা গেল, জীনেদের দল উড়ে

যাচ্ছে আকাশ দিয়ে। তাঁরা সবাই ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁরা

ভেবেছিলেন, হয়তো আজও মিষ্টির ব্যাগ নেমে আসবে আকাশ

থেকে। কিন্তু মিষ্টি পাওয়া গেলনা। জীনেরা মিষ্টির ব্যাগ ফেললো

না। ফেললো একটা আস্ত মানুষের লাশ! সেই মোল্লা বাড়ির মোড়ে, একদিন রাতে এক লোক আসছিলো।

সেই লোক আমাদের এলাকায় নতুন এসেছে। বাজার চেনেনা।

এত রাতে বাজার খোলা থাকে কি না, তাও জানেনা। মোল্লা বাড়ির

মোড়ে এসে তিনি দেখলেন, একজন মহিলা মাথায় লম্বা ঘোমটা

টেনে হেটে যাচ্ছে। তিনি বাজার কোন দিকে তা জিজ্ঞেস করার

জন্য মহিলাকে ডাকলেন, “আম্মা! বাজারটা কোন দিকে?” মহিলার

কোনো সারা-শব্দ নেই। আবারও ডাকলেন। সারা-শব্দ নেই।

তৃতীয় বার ডাকার পর মহিলা দাঁড়ালেন। ঘোমটা খুলে হঠাত যখন

লোকটার দিকে তাকালেন, তখন লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

এইরকম বীভৎস চেহারার কাওকে তিনি জীবনেও দেখেননি।

মহিলার মুখের মাংশ এবড়ো-থেবড়ো। চোখ দুটো বের হয়ে

যাওয়া। এইরকম ঘটনা আমাদের এলাকায় অনেক ঘটে। মাঝে মাঝেই।

হয়তো অনেকের জীবনে এইসব ঘটনা ঘটে, কিন্তু ভয়ে তাঁরা কিছু

প্রকাশ করেন না। হয়তো এরচাইতে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে

গেছে অনেকের জীবনে, আমাদের অজানাতেই। তাঁরা সেইসব

অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছে আমাদের মাঝে। আমি ভূত-প্রেতে অবিশ্বাসী। তবুও আমি একা একা রাতের বেলা

তেমন একটা বের হইনা। এখনও মনে হয়, সেই কেটে ফেলা

আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কেও আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

এখনও মনে হয়, কোনো এক মহিলা লম্বা ঘোমটা টেনে হেটে যায়

মোল্লা বাড়ির মোড়ে। এখনও মনে হয়, মোল্লা বাড়ির মোড়ে

তালগাছেরা কেঁপে যায় গভীর রাতে। মনে হয়, কোঠাবাড়ির বুড়ির

ভিটায় একটা হাতের ছায়া খুঁজে ফিরে তাজা রক্তের সন্ধান। তাজা

রক্তের সন্ধান।।